এও-পিও বানাতে দুদকে গড়িমসি

নজরুল ইসলাম: সচিবালয়ে প্রধান সহকারী, উচ্চমান সহকারী ও সমমান পদগুলো ‘প্রশাসনিক কর্মকর্তা’ ও সাঁটলিপিকার পদকে ‘ব্যক্তিগত কর্মকর্তা’ নামে পরিবর্তন এবং পরবর্তী সময় দ্বিতীয় শ্রেণির (১০ম গ্রেড) পদমর্যাদায় উন্নীত করা হয়। পরে একইভাবে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন (ইসি), বাংলাদেশ কর্ম-কমিশন (পিএসসি) ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনসহ (ইউজিসি) অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেও সচিবালয়ের মতো প্রধান সহকারী, উচ্চমান সহকারী ও সমমান পদগুলো ‘প্রশাসনিক কর্মকর্তা’ ও ‘ব্যক্তিগত কর্মকর্তা’ পদে উন্নীত করা হয়। সম্প্রতি ইউএনও কার্যালয়, ডিসি কার্যালয় ও বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়গুলোতেও প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদের ব্যবহার শুরু করা হয়েছে। কিন্তু দুদকে প্রধান সহকারী, উচ্চমান সহকারী ও সমমানের পদগুলোকে সচিবালয়ের মতো ‘প্রশাসনিক কর্মকর্তা’ ও ‘ব্যক্তিগত কর্মকর্তা’ পদে এখনও উন্নীত করা হয়নি। এতে অসন্তোষ বিরাজ করছে। কর্মচারীদের অভিযোগ, শুধু চিঠি চালাচালিতেই সময়ক্ষেপণ করা হচ্ছে। প্রশাসনিক কর্মকর্তা (এও) এবং ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (পিও) বানাতে দুদক গড়িমসি করছে।

দুদকের ‘প্রধান সহকারী’ পদকে ‘প্রশাসনিক কর্মকর্তা’ ও ‘সাঁটলিপিকার’ পদকে ‘ব্যক্তিগত কর্মকর্তা’ পদে পরিবর্তনপূর্বক উভয় পদকে তৃতীয় শ্রেণি থেকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীতকরণ-সংক্রান্ত মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের জেলা ম্যাজিস্ট্রেসি নীতি অধিশাখার ২০১৬ সালের ২১ মার্চের  চিঠিতে বলা হয়, পদবি পরিবর্তনসংক্রান্ত প্রস্তাবগুলো ‘দুদক (কর্মচারী) চাকরি বিধিমালা, ২০০৮’-এর আওতাভুক্ত বিধায় সামগ্রিক বিষয় একসঙ্গে বিবেচনাযোগ্য। তাই চাকরি বিধিমালা সংশোধন-সংক্রান্ত আরও কোনো প্রস্তাব থাকলে সব প্রস্তাব সমন্বিত করে একত্রে পাঠানোর জন্য দুদককে অনুরোধ করা হলো। কিন্তু এখনও ওই চিঠির আলোকে প্রস্তাব পাঠানো হয়নি।

দুদক নিয়োগবিধি অনুযায়ী, ১৬তম গ্রেডে ডেটা এন্ট্রি/কন্ট্রোল অপারেটর পদের একজন কর্মচারী ন্যূনতম ছয় বছর চাকরি পূর্ণ করে ১৪তম গ্রেডে উচ্চমান সহকারী পদে, ন্যূনতম সাত বছর চাকরি পূর্ণ করে উচ্চমান সহকারী থেকে ১১তম গ্রেডে প্রধান সহকারী এবং ন্যূনতম পাঁচ বছর চাকরি পূর্ণ করে প্রধান সহকারী থেকে ১০ম গ্রেডে উপসহকারী পরিচালক (ডিএডি) পদে পদোন্নতির বিধান রয়েছে। অর্থাৎ ১০ম গ্রেডের পদে পদোন্নতি পেতে ১৬ গ্রেডের একজন কর্মচারীর চাকরির মেয়াদ কমপক্ষে ১৮ বছর পার করতে হয়। কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে ১৬ গ্রেডের একজন কর্মচারী কোনোভাবেই ১৮ বছরে ১০ম গ্রেডে পদোন্নতি পান না। এতে তৃতীয় শ্রেণির পদে চাকরিতে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে অনেক কর্মচারী দুবার পদোন্নতি পেয়েও তৃতীয় শ্রেণির পদ থেকেই অবসরে চলে যান।

একই গ্রেড ও একই শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন বাংলাদেশ সচিবালয়ের ১৬ গ্রেডের একজন কর্মচারী ন্যূনতম পাঁচ বছর চাকরি করেই সরাসরি ১০ম গ্রেডে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে থাকেন। অর্থাৎ তৃতীয়

শ্রেণি থেকে একবার পদোন্নতিতেই দ্বিতীয় শ্রেণির পদে পদোন্নতি পাচ্ছেন। অথচ দুদকে ১৬ গ্রেডের একজন কর্মচারী পরপর দুবার পদোন্নতি পেলেও তৃতীয় শ্রেণির পদেই থেকে যান। অর্থাৎ ১৬ গ্রেডের ডেটা এন্ট্রি/কন্ট্রোল অপারেটর পদের একজন কর্মচারী ছয় বছর পর উচ্চমান সহকারী (গ্রেড-১৪) এবং সাত বছর পর প্রধান সহকারী (গ্রেড-১১) পদে পদোন্নতি পেলেও দুটি পদই তৃতীয় শ্রেণির।

সচিবালয়ে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে ১৬তম গ্রেডে অফিস সহকারী পদে যোগ দিয়ে পদোন্নতি পেয়ে ১০ম গ্রেডে প্রশাসনিক কর্মকর্তা (এও) এবং ১৪তম গ্রেডে সাঁট মুদ্রাক্ষরিক ও ১৩তম গ্রেডে সাঁটলিপিকার পদে যোগ দিয়ে পদোন্নতি পেয়ে ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (পিও) হয়। আর দুদকে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে ১৬তম গ্রেডে যোগ দিয়ে পদোন্নতি পেয়ে প্রথমে ১৪তম গ্রেড, তারপর ১১তম গ্রেড পার করে পরে ১০ম গ্রেডে পদোন্নতি পেয়ে থাকে।

সচিবালয়ের ২০ গ্রেডের একজন কর্মচারী পাঁচ বছরে ১৬ গ্রেডের পদে পদোন্নতি প্রাপ্ত হন। আবার তিনি গ্রেড-১৬ থেকে পাঁচ বছরে সরাসরি ১০ম গ্রেডের প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত হন। অর্থাৎ একই গ্রেড ও একই শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন বাংলাদেশ সচিবালয়ের চতুর্থ শ্রেণির (গ্রেড-২০) একজন কর্মচারী মাত্র ১০ বছরেই দ্বিতীয় শ্রেণির পদে পদোন্নতি পাচ্ছেন। অথচ দুদকে সরাসরি ১৬ গ্রেডে নিয়োগপ্রাপ্ত তৃতীয় শ্রেণির একজন কর্মচারীকে তৃতীয় শ্রেণির পদে দুবার পদোন্নতি পাওয়ার পর তৃতীয় বারে কমপক্ষে ১৮ বছর চাকরি পূর্তিতে দ্বিতীয় শ্রেণির (গ্রেড-১০) পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত হন, যা বাংলাদেশ সংবিধানের ২৯(১) নম্বর অনুচ্ছেদের পরিপন্থি।

দুদকে ১১তম গ্রেডে প্রধান সহকারী ও সহকারী পরিদর্শক এবং ১৪তম গ্রেডে উচ্চমান সহকারী ও কোর্ট সহকারী (এএসআই) পদ বিদ্যমান। এই দুই স্তরের চার পদের কর্মচারীদের ১০ম গ্রেডে একই পদভুক্ত করে প্রশাসনিক কর্মকর্তা; ১৩তম গ্রেডের সাঁটলিপিকার কাম-কম্পিউটার অপারেটর ও ১৪তম গ্রেডের সাঁট মুদ্রাক্ষরিক কাম-কম্পিউটার অপারেটর পদের কর্মচারীদেরও ১০ম গ্রেডে ব্যক্তিগত কর্মকর্তা করার প্রস্তাব রয়েছে। ১১ গ্রেডের হিসাবরক্ষককে হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা, নার্সকে সিনিয়র স্টাফ নার্স, ফার্মাসিস্টকে ফার্মাসিস্ট ও লাইব্রেরিয়ান/ক্যাটালগারকে  লাইব্রেরিয়ান/ক্যাটালগার পদে ১০ম গ্রেডে উন্নীত করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। দুদকের বিদ্যমান সাংগঠনিক কাঠামো যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে সুপারিশ প্রণয়নের নিমিত্ত গঠিত কমিটির কাছে দুদকের কর্মচারীরা তাদের এই প্রস্তাব জানিয়েছেন।

দুদকের ২০২২ সালের ১৩ এপ্রিলের এক চিঠিতে বলা হয়, ২০১৫ সালের ২৬ আগস্ট অনুষ্ঠিত ০৪/২০১৫ নম্বর কমিশন সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ‘প্রধান সহকারী’ পদকে ‘প্রশাসনিক কর্মকর্তা’ ও ‘সাঁটলিপিকার’ পদকে ‘ব্যক্তিগত কর্মকর্তা’ পদে পরিবর্তনপূর্বক উভয় পদকে তৃতীয় শ্রেণি থেকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীতকরণের প্রস্তাব সংশোধিত তফসিলসহ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। পরে দুদকের প্রধান সহকারী ও উচ্চমান সহকারী পদে কর্মরত মো. আবুল ফয়েজসহ মোট ৪৬ কর্মচারী কমিশনের প্রধান সহকারী, উচ্চমান সহকারী ও সমমানের পদগুলোর পদবি পরিবর্তন করে ‘প্রশাসনিক কর্মকর্তা’ করার এবং দুদকের নিয়োগবিধিতে বিদ্যমান প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদটিকে ব্লক থেকে আন-ব্লক পদ করাসহ জাতীয় বেতন স্কেলের দশম গ্রেডে উন্নীতকরণের জন্য আবেদন করেছেন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের জেলা ম্যাজিস্ট্রেসি নীতি অধিশাখার ২০১৬ সালের ২১ মার্চের চিঠির আলোকে কমিশনের প্রধান সহকারী, উচ্চমান সহকারী ও সমমানের পদগুলোর পদবি পরিবর্তন করে ‘প্রশাসনিক কর্মকর্তা’ করার এবং দুদকের নিয়োগবিধিতে বিদ্যমান প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদটিকে ব্লক থেকে আন-ব্লক পদ করাসহ জাতীয় বেতন স্কেলের দশম গ্রেডে উন্নীতকরণের জন্য আবেদনের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ‘দুদক আইন, ২০০৪’ ও অন্য বিধিগুলো আরও যুগোপযোগী করতে প্রয়োজনীয় সুপারিশ প্রণয়নের জন্য গঠিত কমিটি ও সাংগঠনিক কাঠামো সংশোধনের প্রস্তাব প্রণয়নের জন্য গঠিত কমিটির কাছে পাঠানোর প্রস্তাব নথিতে উপস্থাপন করা হলে, কমিশন তা অনুমোদন দিয়েছে। উপপরিচালক (মানবসম্পদ) রফিকুল ইসলাম স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে বিষয়টি ‘দুদক আইন ও বিধি যুগোপযোগীকরণ কমিটি’র আহ্বায়ক দুদক সচিব এবং ‘দুদকের বিদ্যমান সাংগঠনিক কাঠামো যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে সুপারিশ প্রণয়নের নিমিত্তে গঠিত কমিটি’র আহ্বায়ক দুদকের মহাপরিচালককে (মানি লন্ডারিং) অবহিত করা হয়েছে।

সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের (পরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়) ১৯৯৫ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর সম(সওব্য/টিম-১(সংস্থাপন)-সাকো:২৪/৯৪/১৭০ নম্বর প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী বাংলাদেশ সচিবালয়ের প্রধান সহকারী, উচ্চমান সহকারী ও সমমান পদগুলো ‘প্রশাসনিক কর্মকর্তা’ ও সাঁটলিপিকার পদকে ‘ব্যক্তিগত কর্মকর্তা’ নামে পরিবর্তন এবং পরবর্তী সময় দ্বিতীয় শ্রেণির (১০ম গ্রেড) পদমর্যাদায় উন্নীত করা হয়।

দুদকের গড়িমসির বিষয়ে জানতে দুদক সচিব মাহবুব হোসেনের মোবাইল ফোন নম্বরে গত ৫ মার্চ ও ৮ মার্চ কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে গত ২২ ফেব্রুয়ারি ও ৮ মার্চ জানানো হলেও তিনি কোনো উত্তর দেননি।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০