একক পরিবারে শিশুদের সামাজিকীকরণের সীমাবদ্ধতা

যুগের হাওয়া বদলেছে। দেশের আনাচে-কানাচে ইন্টারনেট পৌঁছানোর ফলে যোগাযোগ এখন হাতের মুঠোয়। মুহূর্তেই করা যাচ্ছে তথ্য আদান-প্রদান। দুই দশক আগেও যেখানে এসব কল্পনাই করা যেত না, সেসব এখন বাস্তবে, আর স্বপ্ন নয়। এতসব উন্নতি, এত সুবিধার পেছনে সমাজের মানুষ কিছু একটা যেন হারিয়েছে। কী হারিয়েছে সেসব হয়তো ভেবেও দেখে না কোনোদিন। তারা হারিয়েছে মূল্যবান সময় এবং যৌথ পরিবারে এক চুলোয় এবং একই হাঁড়িতে থাকা-খাওয়ার স্মৃতি। এক প্রজš§ পিছালেই আমরা দেখতে পারব দাদা-দাদি, মা-বাবা, চাচা-চাচিসহ অন্যান্য আত্মীয়রা একসঙ্গেই থাকছেন, কাজ ভাগাভাগি করে কেউ উঠোন ঝাড়ু দিচ্ছেন, কেউবা রান্নার দায়িত্বে আছেন। বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ যিনি পান-সুপারি কাটতে কাটতে গল্পগুজব করছেন পাশের বাড়ির আর কারও সঙ্গে। কয়েক কেজি চাল লাগছে একবেলা খেতে তারপরও তাদের কোনো আপত্তি থাকত না। পরিবারের ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে নানা ধরনের খেলা খেলছে যেমন গোল্লাছুট, কানামাছি, লুকোচুরি, দাড়িয়াবান্ধাসহ নাম না জানা আরও কত কি। এভাবে শরীরে মাটি লাগাচ্ছে, খেলছে, তাদের মন ভালো হচ্ছে। আবার সন্ধ্যা হলে হারিকেন, কেরোসিনের কুপি জ্বালিয়ে বারান্দায় পড়তেও বসছে, সকালে খেয়ে না খেয়ে বিদ্যালয়ে পড়তেও যেত তারা। এই যে সেই সময়গুলো হারিয়ে গেল সেই সময়গুলোর পুনরাবৃত্তি আর হয় না। তাদের সামাজিকীকরণের চিত্রটাই আলাদা ছিল। সামাজিক আচার-আচরণ, পরিবারের সবার প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, হাসি-আনন্দ-দুঃখ ভাগাভাগি করার মাধ?্যমে দৃঢ় মানবিক বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার গুণাবলি শিশুরা যৌথ পরিবার থেকেই শিখে থাকে। কীভাবে একজনের সঙ্গে কথা বলতে হয়, মিশতে হয়, বাড়িতে কেউ এলে বসার চেয়ার এগিয়ে দিতে হয়, সালাম দিতে হয়। যারা একসঙ্গে একই যৌথ পরিবারে থেকেছে তারা খুব ভালো মতোই এই মানবিক গুণগুলো শিখতে পেরেছে। পড়াশোনায় খারাপ করলে শিক্ষকের বেতের আঘাতে উল্টো আঘাত করতে শেখেনি। তারাই আবার ক্লাসে সবার চেয়ে বেশি নম্বর পেয়ে মেধার স্বাক্ষর বহন করত। তখন এত কম সুবিধা পেয়েও আগের প্রজšে§র ছেলে-মেয়েরা এগিয়ে নিয়ে গেছে একটা আদর্শিক সমাজ বাস্তবায়নে। আজ পেছন ফিরে তাকাতে গেলে শুধু শূন্য ছাড়া আর কী বা দেখা মেলে। এই ইন্টারনেটের যুগে, এই আধুনিক সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে টুকরো কাচের মতো হয়ে গেছে। একই শহরে, একই এলাকায় থাকা হলেও কথা হয় না। কেউ তো আর আগের মতো একসঙ্গে থাকেই না, খাওয়া পরের কথা। একসঙ্গে খেতে বসলে কত কথা হতো, সবার সঙ্গে মন খারাপের কথাই আসত না। চাকরির সুবাদে বা অন্যান্য কারণে মা-বাবা থাকেন এক জায়গায় তাদের ছেলেমেয়ে আরেক জায়গায়। এতে পরিবারের ছেলেমেয়েরা দাদা-দাদির স্নেহ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। মা-বাবা দুজনের চাকরির কারণে বাচ্চা বড় হচ্ছে কোনো ডে-কেয়ারে বা গৃহকর্ত্রীর কাছে। এতে বাচ্চার আচরণে সমস্যা দেখা দেয়। যে শিশুটি যৌথ পরিবারে বেড়ে উঠবে তার মধ্যে সামাজিকতাবোধ জš§াবে, পরার্থপরতা শিখবে, অন্যের প্রতি সমব্যথী হবে ইত্যাদি। কিন্তু দাদা-দাদি কিংবা মা-বাবার অনুপস্থিতিতে সে এসবের শিখবে খুবই কম। তবে এতে করে শিশুটির সামাজিকীকরণে অনেক অনেক ঘাটতি থেকে যাবে। যৌথ পরিবারের ছেলেমেয়েরা রাত হলে দাদু-নানুর কাছে গল্প শুনে শুনে ঘুমিয়ে যেত। একটা ঘটনার পর আরেকটা ঘটনা শোনার আগ্রহ তাকে কৌতূহলী করে তুলত। কিন্তু এখনকার এই সময়ে কিছু একটা ঘাটতি তো থেকেই যাচ্ছে। যেখানে সে কারও সঙ্গে খেলতে মাঠে যেত সেখানে সে বদ্ধ ঘরে থেকে মোবাইল গেমসের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে, যা খুবই বিপদের সংকেত বহন করছে। সময়ের প্রয়োজনেই যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে ছোট ছোট একক পরিবার গঠন করছে। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, বর্তমান সময়ে আধুনিক নগরায়ণ ও শিল্পায়ন, অর্থনৈতিক কর্মসংস্থান, স্বনির্ভরতা বৃদ্ধি, ব্যক্তিস্বাধীনচেতা, আত্মকেন্দ্রিকতাসহ নানা কারণে যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবার হচ্ছে। মূল কথা এই যে যেভাবে থাকতে চায়। তবে অভিভাবকদের আরও একবার ভাবতে হবে একসঙ্গে একই ছাদের নিচে থেকে আগামী প্রজšে§র সুষ্ঠু বিকাশে সহযোগিতা করা। নয়তো মানসিক বিকাশে থেকে যাবে বাধা, যা আগামী দিনের জন্য হুমকিস্বরূপ।

মাহমুদুল হাসান মিল্টন

শিক্ষার্থী, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০