সুধীর বরণ মাঝি: খেলার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা রয়েছে। আমাদের হƒদয় এবং মস্তিষ্ক উšে§াচন করে। ভেদাভেদ, নানা বাধা অতিক্রম করার রাস্তা খুলে দেয়। বিশ্বক্রীড়া জগতে অলিম্পিক গেমস একটি শ্রেষ্ঠতম আসর। যেখানে মহামিলন ঘটে বিশ্বের খেলোয়াড়, ক্রীড়া সংগঠক আর ক্রীড়াপ্রেমীদের। এখানে সবাই ব্যস্ত প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে নিজ নিজ নৈপুণ্য প্রদর্শনের মাধ্যমে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে। যারা শুরুটা হয়েছিল ৭৭৬ অব্দে গ্রিক দেবতা জিউসের পুজো উপলক্ষে এক ধর্মীয় অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে এই অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার। আর আধুনিক অলিম্পিকের যাত্রা শুরু হয় ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দে ব্যারেন পিয়ারে দ্যা কুবার্তিনের হাত ধরে। যার শুভ সূচনা হয় গ্রীসের রাজধানী এথেন্সে ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দে ১৩টি দেশের ৩১১ জন ক্রীড়বিদের ৯টি ইভেন্টের ক্রীড়া প্রতিযোগিতার মাধ্যমে। প্রতি চার বছর পর পর এই প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়।
ক্রীড়া জগতের এই মহাযজ্ঞে আমাদের অংশগ্রহণ শুরু হয় ১৯৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের লসএঞ্জেলস অলিম্পিকে অ্যাথলেটিকসের সাইদুর রহমান ডনের অংশগ্রহণের মাধ্যমে। ১৯৮৪ সাল থেকে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অলিম্পিক গেমস অংশগ্রহণ শুরু হয় এবং বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রতিটি অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করে যাচ্ছি পদকের আশায় কিন্তু কোনো পদকই আমাদের হাতছানি দেয় না। প্রায় ২০ কোটি মানুষের দেশ বিজয়ে গৌরব নয়, অংশগ্রহণেই গৌরব এই অর্থে আমাদের সফলতা অংশগ্রহণে আর বাকি সবই ব্যর্থতা। আমরা অলিম্পিকের প্রতিটি আসরেই দেখি আমাদের থেকে কম জনসংখ্যার এবং দরিদ্র দেশও অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করে পদক জয় করে নেয়? ওরা যদি পারে তবে আমরা কেন পিছিয়ে এই প্রশ্নের বিশ্লেষণের এবং উত্তর খোঁজার সময় এখন আমাদের হাতে বলে বিশ্বাস করি। আর যদি এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর খুঁজে পাই এবং সেই অনুযায়ী সঠিক পরিকল্পনা করে বাস্তবায়ন করতে পারি তবেই হয়তো আগামী দু-একটি অলিম্পিকেই আমাদের সেই অতি কাক্সিক্ষত অলিম্পিক পদকের দেখা পেতে পারি। অলিম্পিক সফলতা ধরা দিতে পারে বাংলাদেশের ক্রীড়া জগতে।
আমরা দেখি প্রতিটি অলিম্পিকেই আমাদের অ্যাথলেটদের চেয়ে কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি। তাতেও দুঃখ থাকত না যদি না কোনো একটি অলিম্পিক থেকে আমাদের কোনো একটা অর্জন থাকত। আমাদের সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে এবং পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করতে হবে। এমনটা যেন না হয়, পরিকল্পনা করার পর পরই ডানা মেলে উড়ে চলে গেল আর কল্পনা একাকী বসে থাকল। তাহলে কিন্তু! পদক পাওয়ার আশা কোনো দিনই পূরণ হবে না। আশা আশাই থেকে যাবে। ক্রীড়া ক্ষেত্রে আমাদের বাজেটও পর্যাপ্ত বলে মনে হয়। বাজেট আছে তার ব্যবহারও আছে তবে ফলাফল কেন শূন্য এই প্রশ্নের মূল্যায়ন করতে হবে। সময়ের চাহিদাকে বিবেচনা করতে হবে আগামীর সফলতার জন্য। দেশকে নিয়ে ভাবতে হবে, দেশের সম্মান নিয়ে ভাবতে হবে শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবলেই চলবে না তথাকথিত ক্রীড়া অনুরাগী কর্তাব্যক্তিদের।
ক্রীড়াতে সুখ আনে, সম্মান আনে, ধন আনে, খ্যাতি আনে, ক্রীড়াতেই বিশ্বজয়, ক্রীড়াতেই শক্তি। ক্রীড়াতে ভ্রাতৃত্ব, সম্প্রীতি গড়ে উঠে, জাগ্রত হয় দেশপ্রেম। বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে হয় আমরা অনেকটাই পেছনে। এত এত’র পরও আমরা কেন বার বার ব্যর্থ হাতে ফিরছি। এক ক্রিকেট ছাড়া আমাদের বড় কোনো সাফল্য আছে বলে মনে হয় না। আর ক্রিকেটের যতটুকু সফলতা আছে তাও ধারাবাহিকভাবে রক্ষা করা যাচ্ছে না। ফলে আন্তর্জাতিক বড় কোনো আসরে সফলতাও আসছে না। আর্চারি এবং শুটিংয়ের ক্ষেত্রেও আমাদের কিছু সাফল্য রয়েছে এবং তাও আবার অনিয়মিত। জনপ্রিয় ফুটবল আজ প্রায় মৃত। ফুটবল ফেডারেশনসহ অন্যান্য ফেডারেশানগুলোও প্রায় মৃত। তারা নামকাওয়াস্তে কিছু টুর্নামেন্ট করেই ক্ষান্ত থাকে।
আর এতে কিছু ব্যক্তিদের পকেট গরম। আজকে কয়েক বছর পর্যন্ত টেলেন্ট হান্ট দেখি কিন্তু এর বড় কোনো সাফল্য চোখে পড়ে না। বিশেষ অলিম্পিকে যদি আমরা পদক নিয়ে আসতে পারি তবে স্বাবলম্বীরা কেন খালি হাতে ফিরবে? তাই নতুন করে আমাদের ভাবতে হবে। যাতে প্রতিটি গেমস থেকেই আমরা পদক হাতে ফিরতে পারি। আমারা কেন পারলাম না, আমাদের ব্যক্তিগত ও দলীয় ঘাটতি খুঁজে বের করতে হবে। কীভাবে কাজ করলে আমরা পদক পেতে পারি। ব্যর্থতার গ্লানি এবং আগামী দিনকে জয় করার প্রত্যয় নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।
মিডিয়ার কারণে বিভিন্ন সময়ে দেখেছি ফেডারেশনের সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্তব্যক্তিদের দুর্নীতি, লুটপাট আর স্বজনপ্রীতি। আমরা যদি কর্তাব্যক্তিরা দুর্নীতি, লুটপাট আর স্বজনপ্রীতি থেকে নিজেদের মুক্ত করতে না পারি তবে কোনো দিনই বড় কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিযেগিতা থেকে পদক নিয়ে আসতে পারব না। ফেডারেশনের কর্তাব্যক্তিরা নিজের এবং স্বজনদের বাহিরে কোনো কিছু চিন্তা করতে পারে না বলেই আজকে আমাদের এই অবস্থা। জেলা ও উপজেলা ক্রীড়া সংস্থাগুলোতে দলাদলি, কোন্দল, আত্মীয়করণ, স্বেচ্ছাচারিতা প্রভৃতি লেগেই আছে। ফেডারেশন এবং জেলা ও উপজেলা ক্রীড়া সংস্থাগুলোতে অতি তোষামোদকারী একশ্রেণির লোকদের সবসময় ঘুরঘুর করতে দেখা যায়। এই তোষামদকারী থেকে সাবধান হতে হবে এবং নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে হবে ক্রীড়ার উন্নতি এবং সাফল্যের জন্য। খেলার মাঠগুলো বিভিন্নভাবে দখল হয়ে যাচ্ছে। তৃণমূল পর্যায়ে নিয়মিত লেখাধুলার কোনো ব্যবস্থা নেই, নেই পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। খেলাধুলার রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা তৃণমূল পর্যায়ে নিয়মিত না। আমাদের এই দৈন্য ঘোচাতে হলে ফেডারেশনগুলোকে ঢেলে সাজাতে হবে, যারা সত্যিকারের ক্রীড়া অনুরাগী; তাদের নিয়ে কাজ করতে হবে।
আমরা যদি সততা এবং নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে মাঠ পর্যায় থেকে খেলোয়াড় বাছাই করতে পারি, তবে সেই দিন হয়েতো খুব বেশি দূরে নয় যেইদিন আমরা বড় কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিযেগিতা থেকে স্বর্ণপদক নিয়ে দেশে ফিরব। কর্তাব্যক্তিরা যদি আমি এবং আমার এই ভাবনা থেকে ঊর্ধ্বে ওঠতে না পারেন তবে যতই পরিকল্পনা করা হোক, যতই বরাদ্দ দেওয়া হোক কাজের কাজ কিছুই হবে না, কর্তাব্যক্তিদের পকেট ভর্তি ছাড়া। দেশের প্রতি অগাধ ভালোবাসা, গভীর দেশেপ্রেম এবং দায়িত্ব নিয়ে কাজ করলে সুফল আসবেই।
খেলোয়াড় বাছাই ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি পরিহার করতে হবে। খেলাধুলায় বরাদ্দের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। সাধ্যের মধ্যে মানসম্মত প্রশিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। প্রশিক্ষকদের কাজের স্বাধীনতা যেমন দিতে হবে তেমনি জবাবদিহিতাও থাকতে হবে। খেলোয়াড়দের নিয়মিত শারীরিক এবং মানসিক পরিচর্যা করতে হবে। যেখানে যতটুকু সম্ভব খেলোয়াড়দের আর্থিক দায়িত্ব নিতে হবে। খেলতে হবে দেশের জন্য, সফলতা আসবে নিজের জন্য। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়মিত খেলাধুলার আয়োজন করতে হবে। খেলোয়াড়দেরও সর্বোচ্চ উজাড় করে দিয়ে খেলার কমিটমেন্টের জায়গায় নিতে হবে। দ্বায়বোধ এবং সততা জাগ্রত না হলে কোনো দিনই আমাদের পদক অর্জন করা সম্ভব নয়। যদি লক্ষ্য থাকে অটুট, বিশ্বাস হƒদয়ে হবেই হবে দেখা দেখা হবে বিজয়ে।
সবশেষ দেশের ক্রীড়া ক্ষেত্রের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের কাছে বিনীত অনুরোধ আর নয় হেলাফেলা, এবার একটু গভীর মনোযোগ দিয়ে ভাবুন। নিজেদের মধ্যে দেশপ্রেমকে জাগিয়ে তুলে তা খেলোয়াড়দের মধ্যে প্রসারিত করুন। কীভাবে বহির্বিশ্বে দেশের সম্মান বৃদ্ধি করা যায়? কীভাবে ক্রীড়া ক্ষেত্রে সমৃদ্ধি ও সাফল্য অর্জনের জন্য। আমাদের দেশের মাটি যেমনি পৃথিবী সেরা উর্বর ঠিক তেমনি আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা একটু সঠিক যত্ন এবং পরিচর্যা পেলেই অনেক বড় কিছু করতে পারে তার অনেক প্রমাণ আমাদের সামনে রয়েছে। আমাদের দেশের খেলোয়াড়রাও একদিন ক্রীড়া ক্ষেত্রে বিশ্বজয় করবেন, অলিম্পিক গেমসসহ সব আন্তর্জাতিক ক্রীড়ায় সাফল্য নিয়ে আসবেন, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সম্মান এবং সুনাম দুটোই বৃদ্ধি পাবে। বিশ্ব ক্রীড়া জগতের এই সর্ববৃহৎ ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় একদিন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত বাজবে, জাতীয় পতাকা উড়বে, গর্বে আনন্দে আমাদের মনপ্রাণ নেচে উঠবে, চোখের কোনে আনন্দ অশ্রু ঝড়বে এই প্রত্যাশা আমাদের সবার। ‘গেমস ওয়াইড ওপেন’ সেøাগানের মতোই যেন বলা যায়, খেলার খোলা মঞ্চে, হাল ছাড়া যাবে না এত সহজে।