সময়টা ছিল ১৯৭১ সাল, তখন বাংলাদেশ যেমন সর্বপ্রথম অর্জন করে একটি লাল-সবুজের পতাকা, তেমনি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড খচিত একটি মানচিত্র। প্রশ্ন হলোÑএর আগে কি বাংলাদেশ স্বাধীন ছিল? না, তখনও স্বাধীন ছিল না পর্তুগিজ থেকে শুরু করে ব্রিটিশ শাসন আমল পর্যন্ত একের পর এক বিভিন্ন শাসকগোষ্ঠী এদেশের মানুষকে একের পর এক করেছে নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত। কিন্তু সেই সময় তারা যেমন ছিল কিছুটা ভীতসন্ত্রস্ত, তেমনি তারা ছিল পরিস্থিতির স্বীকার। অতঃপর একপর্যায়ে ১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ জানুয়ারি যুক্ত ভারতবর্ষ থেকে পৃথক হয় ভারত ও পাকিস্তান। সদ্য গঠিত পাকিস্তানের দুটি অংশ ছিল পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান। দুই পাকিস্তানের মধ্যে ব্যবধান ছিল ১২০০ মাইল। এই দীর্ঘ ১২০০ মাইলের দূরত্বও আমাদের অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে বৈষম্য ও নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই দিতে পারেনি। প্রথমেই তারা আঘাত হানে আমাদের ভাষার ওপর। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রথম উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবি উত্থাপন করেন। কিন্তু আমাদের মাতৃভাষা অর্থাৎ মায়ের ভাষা তারা কেড়ে নেওয়ার জন্য মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ প্রথম ঘোষণা করেন উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। অতঃপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ মিছিলে বের হয় এবং সেই মিছিলেও গুলিবর্ষণ করা হয়। এখান থেকেই শুরু পূর্ব পাকিস্তানের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের বর্বরতার ইতিহাস। কিন্তু এই বর্বরতা রোধে বাঙালির তখন যেমন কিছুটা চেতনা জাগ্রত হতে শুরু করে সেই সঙ্গে তারা একজন পথপ্রদর্শকেরও সন্ধান পান, যিনি এক আঙুল উঁচিয়ে দিয়েছিলেন বাঙালির অত্যাচার, নির্যাতন ও পরাধীনতার হাত থেকে বাঁচার জয়গান। সেই বঙ্গবন্ধু, যিনি শুধু একজন পথপ্রদর্শকই ননÑএকটি জাতির সুমহান নেতা। সারাটা জীবন যিনি বাঙালির মুক্তির চিন্তায় মগ্ন ছিলেন। মোট ৪ হাজার ৬৮২ দিন অন্ধকার কারাগারে কাটানোর পরও যিনি তার লক্ষ্য থেকে এক চুলও নড়েনি। ৭ মার্চের সেই ভাষণের পর থেকে বাঙালির লুকায়িত সাহস ও চেতনার অনেকটাই বহিঃপ্রকাশ ঘটে। তারা বঙ্গবন্ধুর কথা অনুযায়ী ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলে এবং নেমে পড়ে রাজপথে। যদিও বাঙালির আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ছিল না এবং তারা অস্ত্র চালনায় পারদর্শী ছিল না; তবুও তারা তাদের যা কিছু আছে তাই নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এই স্বাধীনতার জন্য জাহানারা ইমাম তার একমাত্র ছেলে রুমীকে উৎসর্গ করতেও দ্বিধা বোধ করেননি। দীর্ঘ ৯ মাস বাঙালির ওপর চলে রক্তক্ষয়ী অত্যাচার ও নির্যাতন। প্রায় ত্রিশ লাখ মানুষের জীবন আর দুই থেকে চার লাখ নারীর সম্মানের বিনিময় হলো আমাদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের প্রচেষ্টা এবং পরাধীনতার শিকল হতে মুক্তির প্রত্যয়। পশ্চিম পাকিস্তানিরা এতটাই নির্মম ছিল, তারা যেখানে যে অবস্থাতেই বাঙালিদের পেত তখনই তাদের হত্যা করত। তাদের সেই অত্যাচারের ইতিহাস আজও বাঙালি জাতির কাছে অত্যন্ত ঘৃণার ইতিহাস। কিন্তু বাঙালিরা কখনোই তাদের অত্যাচারকে ভয় পেয়ে দূরে সরে থাকেনি বরং তারা তাদের সর্বোচ্চ দিয়ে লড়াই করেছে, এমনকি কখনও জীবন দিতেও কোনো দ্বিধাবোধ করেনি। অবশেষে তারা যখন এটা বুঝতে সক্ষম হয়েছিল, বাঙালিরা হাল ছাড়বার বা হেরে যাওয়ার পাত্র নয়, ঠিক তখনই তারা তাদের এই অত্যাচারের ইতিহাসের পরিসমাপ্তি জানাতে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর, দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার, জেনারেল নিয়াজিসহ মোট ৯৪ হাজার সৈন্যবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। এ সময় এদেশের পক্ষে বা ভারতীয় বাহিনীর পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করে জেনারেল অরোরা। আর এভাবেই সূচনা ঘটে একটি স্বাধীন সার্বভৌম নতুন রাষ্ট্রের; যার নাম দেয়া হয় বাংলাদেশ। যদিও আমরা আজ এত সুন্দর একটি দেশে স্বাধীনভাবে বসবাস করতে পারছি, কিন্তু এর পেছনের ইতিহাসটি ছিল অত্যাচার, নির্যাতন ও পরাধীনতার সেকলে আবদ্ধ বেদনাতুর কিছু স্মৃতিতে ভরপুর।
সামিয়া খানম
শিক্ষার্থী
শিক্ষা ও গবেষণা বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়