একটি মহাকাব্যিক ভাষণ এবং জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা

সাধন সরকার:‘একটি কবিতা লেখা হবে তাঁর জন্য কী দারুণ অপেক্ষা আর উত্তেজনা নিয়ে/লক্ষ লক্ষ উম্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে/ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে/‘কখন আসবে কবি’?/… শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে/রবীন্দ্রনাথের মতো দীপ্ত পায়ে হেঁটে/অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন/তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল, হƒদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার, সকল দোয়ার খোলা। কে রোধে তাহার বজ কণ্ঠ বাণী?/গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তার অমর কবিতাখানি/এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম/এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম/সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বহুল প্রতীক্ষিত শিহরণ জাগানো ঐতিহাসিক ৭ মার্চের বজ কণ্ঠের ভাষণের মুহূর্তটি এভাবেই কবির কবিতায় উঠে এসেছে। ১৯৭১ সালে পুরো জাতি যখন স্বাধীনতার জন্য অধীর অপেক্ষায়, ঠিক তখনই মহাকাব্যের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কণ্ঠ থেকে ধ্বনিত হয়েছিল স্বাধীনতার ঘোষণা। প্রজš§ থেকে প্রজন্মন্তরে মহান আত্মত্যাগের অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে এই ভাষণ। জাতির পিতা এই ভাষণে স্বাধীনতার চূড়ান্ত আহ্বানটি দিয়েই ক্ষান্ত হননি, স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনাও দিয়েছিলেন। মুক্তিকামী মানুষের জন্য এই ভাষণের আবেদন চিরস্থায়ী। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মুক্তিকামী, অর্থনৈতিক অধিকার ও বঞ্চনার শিকার মানুষের জন্য এই ভাষণ হতে পারে অনন্ত প্রেরণার উৎস। এ ভাষণকে সর্বকালের সেরা ভাষণ বললেও অত্যুক্তি হবে না, কেননা বিশ্বের আর কোনো দেশের নেতার ভাষণ ৭ মার্চের ভাষণের মতো মানুষের মনে আবেদন সৃষ্টি করতে পারেনি। এই বজ কণ্ঠের বাণী ছিল অলিখিত এবং এক স্বাধীনতাকামী বক্তার ভাষণ। মূলত এ ভাষণই ছিল বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল ভিত্তি। এক কথায়, ৭ মার্চের ভাষণের পরেই স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয় এবং অতঃপর চূড়ান্ত বিজয়ের পথে এগিয়ে যেতে থাকে দেশ।

১৯ মিনিটের এই ভাষণ শুনলে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের পুরো চিত্র ফুটে ওঠে। ত্রিশ লাখ শহীদের রক্ত আর দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে গড়ে ওঠা সভ্যতা বিশ্বে আর কোথাও নেই। ভাষণের অবিনাশী মর্মবাণী মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই নারী-পুরুষ সবাইকে উদীপ্ত করেছিল। ইউনেস্কোর স্বীকৃতির পর ভাষণটি এখন বিশ্ব ঐতিহ্যের অমূল্য দলিল। ৫০ বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু আমাদের জন্য এ ভাষণের প্রত্যেকটি কথা এখনও এক-একটি দিক নির্দেশনা। তরুণ জনগোষ্ঠীর কাছে সমসময় এ ভাষণ অনন্ত প্রেরণা। জাতির পিতা এক স্বনির্ভর স্বপ্নের সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। বাংলাদেশ সে পথেই এগিয়ে চলেছে। বাংলাদেশ বিশ্বে আজ উন্নয়নের রোল মডেল। সমৃদ্ধির অদম্য অগ্রযাত্রার পথে রয়েছে বাংলাদেশ। গত কয়েক বছর ধরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের ওপরে অবস্থান করছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বর্তমানে প্রায় ৪৪ বিলিয়ন ডলার। তৈরি পোশাকশিল্পের প্রবৃদ্ধিও ভালো। গত কয়েক বছর ধরে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রয়েছে। ২০২১ সালের মধ্যে ‘মধ্যম আয়ের ডিজিটাল বাংলাদেশের’ পথে এগিয়ে চলেছে দেশ। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের তমকা লেগেছে পৃথিবীর বৃহত্তম এ বদ্বীপে। ২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশ পার্শ্ববর্তী অন্যান্য দেশের থেকে এগিয়ে রয়েছে। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অভাবনীয় সাফল্য দেখিয়েছে। কৃষি ক্ষেত্রেও সাফল্য আসছে। নারীর ক্ষমতায়ন বাড়ছে। কর্মক্ষেত্রে নারীর প্রবেশ বাড়ছে। শিশুমৃত্যু ও মাতৃমৃত্যুর হার কমানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় ভালো অবস্থানে আছে। গড় আয়ু বেড়েছে, বেড়েছে সাক্ষরতার হার।

কভিডকালে সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশও কঠিন বাস্তবতা ভুলে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। স্বাধীনতার এ স্বপ্নযাত্রায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশকে সামনের দিনগুলোতে অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে হলে আরও বেশ কিছু বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। পরীক্ষা ও পাসের হারের চেয়ে শিক্ষার মানের দিকে নজর দিতে হবে। বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষায়। পরিবেশের দূষণসহ বিভিন্ন সূচকে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। সব ক্ষেত্রে  সংশ্লিষ্ট আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। সব ক্ষেত্রে দুর্নীতি রোধ করতে হবে। অর্থ পাচার রোধ করতে হবে। ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ধনী-গরিবের বৈষম্য দিন দিন বেড়েই চলেছে। তাই অর্থনৈতিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে এগিয়ে যেতে হবে। বৈষম্য কমাতে অর্থনৈতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার জরুরি। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ! মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পাশাপাশি সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। গণতন্ত্র সূচকে বাংলাদেশকে আরও উন্নতি করতে হবে। দেশের উন্নয়নে সব পর্যায়ের তরুণ জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগাতে হবে। তরুণ জনগোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের দাবি অনুযায়ী চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়াতে হবে। দেশের উন্নয়নে বিনিয়োগের সব ধরনের  সমস্যা দূর করে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে। সর্বোপরি জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। মনে রাখা দরকার, এখনকার শিশুদের

আগামীতে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মোকাবিলা করতে হতে পারে। সে হিসেবে শিক্ষাসহ সব ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ ঘটাতে হবে। জাতির পিতা সব ধরনের শোষণ-বৈষম্যবিহীন সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তারই স্বপ্ন দেখানো পথে ভেদাভেদ ভুলে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা তথা উন্নত দেশ গড়ার ভার এখন তরুণদের হাতে। তরুণদের দেশপ্রেমের আগুনে পুড়ে খাঁটি হতে হবে, দেশকে ভালোবাসতে হবে। সর্বোপরি যার যার অবস্থান থেকে বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ করে যেতে  হবে।

ফ্রিল্যান্স লেখক ও পরিবেশকর্মী

sadonsarker2005৥gmail.com

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০