ইকবাল হাসান: বর্তমান পৃথিবীর প্রধান চালিকাশক্তি প্রতিযোগিতা। এক কর্মীর সঙ্গে আরেক কর্মীর কাজগুলো দ্রুত করার প্রতিযোগিতা, বিনিয়োগের প্রতিযোগিতাসহ আরও বিবিধ প্রতিযোগিতায় পৃথিবীর অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি এগিয়ে চলছে। বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে থেকে শুরু হয়ে একবিংশ শতাব্দীর পুরোটাজুড়েই চলছে প্রযুক্তির নতুন নতুন উদ্ভাবন। এক একটি উদ্ভাবন আগের প্রযুক্তিকে অনেকটা বেকার করে তুলছে!
স্মার্টফোনগুলোর কথা চিন্তা করলেও দেখা যাবে কয়েক মাস অন্তর অন্তর স্মার্টফোনগুলো আগের তুলনায় দ্রুতগতির হচ্ছে। এ গতির সঙ্গেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের দেশের অর্থনীতি এখনও মূলধন-নির্ভর হয়ে উঠেনি। এখনও আগের মতোই শ্রমিক-নির্ভর। এর প্রধান কারণ, আমাদের দেশে সস্তায় শ্রমিক পাওয়া যায়!
অন্য দেশগুলোও আমাদের দেশ থেকে শ্রমিক নিয়ে যায় খুবই কম বেতনে। কারণ, অতি অল্প টাকা বেতন দিয়ে আমাদের গাধার মতো খাটিয়ে নেওয়া যায়। পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ দাবি করে, প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক বাংলাদেশের পোশাকশিল্পে কাজ করে। তাদের মধ্যে আশি ভাগ নারী শ্রমিক কাজ করছে। এবং এ খাত থেকে প্রতি বছর বৈদেশিক মুদ্রার প্রায় ৭০ শতাংশেরও বেশি আয় হয়। বিশ্বে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয় অবস্থানে। বাংলাদেশে পোশাক খাত টিকে আছে অনেকটা এ শ্রমিকদের ওপর নির্ভর করে। আমাদের দেশে সস্তা শ্রমিক থাকার ফলে উৎপাদন খরচও কম হয় এবং বিশ্ববাজারে কম মূল্যের জন্য আগ্রহও বেশি থাকে। কিন্তু আজ যদি কোনো শ্রমিককে কাজ থেকে বের করে দেওয়া হয় সে বড়জোর একই রকম আরেকটি কাজ খুঁজে নেবে অন্য আরেকটি কোম্পানিতে কিংবা কোনো কাজই পাবে না।
এ একই উদাহরণ আমাদের বর্তমান তরুণ প্রজন্মের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তাদের জীবনের লক্ষ্যগুলো কি আমাদের সমাজের কাছে স্পষ্ট? তারা আজীবন শুনে আসে শুধু পড়ো, পড়ো। বাংলাদেশের যারাই প্রথম শ্রেণির চাকরি করছে তাদের আবেদনের যোগ্যতা ন্যূনতম স্নাতক। এতসব স্নাতকওয়ালারা পড়ালেখা করে কোথায় যাবে? এই প্রশ্নটা করা কি বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা আমাদের সমাজ, অভিভাবকরা শিখিয়েছে কখনও?
আজও আমাদের দেশে কাজ থেকে সনদে গুরুত্ব দেওয়া হয় বেশি। একজন নবীন শিক্ষার্থী যে সবেমাত্র স্কুলে যাওয়া শিখছে তাকে চাপিয়ে দেওয়া হয় বস্তা বস্তা বই। তাতে, তার মানসিক ও শারীরিক উন্নতি চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। যে বয়সে তাদের থাকার কথা ছিল খেলার মাঠে, সে বয়সে তারা তাদের সময়ের বেশিরভাগ ব্যয় করছে লেখাপড়ায়; যেটার কোনো দরকারও নেই। জীবনের প্রথম পাঠেই বাবা-মা শিখিয়ে দেয় সনদ অর্জনের কথা কোনো ব্যবহারিক জ্ঞান কিংবা অন্য এ রকম কোনো কাজ নয়। ধীরে ধীরে জীবনের চাপ ও পড়ালেখার হাতুড়ির নিচে পৃষ্ট হয়ে আসে বিশ্ববিদ্যালয়ে! অন্য সব শিক্ষার্থীদের মধ্যে তারাও পড়ালেখা করেই কাটায়। দিনশেষে কোনো সরকারি চাকরির জন্য ফর্ম কিনতে লাইনে দাঁড়িয়ে হোক সেটা তার পঠিত বিষয়ের বিপরীত। এভাবেই চাকরির তাড়নায় বর্তমান তরুণরা তার ভেতরের সম্ভাবনা ধ্বংস করে চাকরিপ্রার্থী হয়। অনেকে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বড়জোর মাইক্রোসফট অফিসের কিছু কাজ শিখে অতিরিক্ত যোগ্যতা নিজেদের জীবনবৃত্তান্ত দেখানোর জন্য।
বর্তমান বিশ্ব এগিয়ে চলছে ইন্টারনেট, প্রযুক্তির মাধ্যমে। আর আমরা সেখানে পিছিয়ে আছি। সামনের বিশ্বে দেখা যাবে মানুষবিহীন গাড়ি, যেখানে রোবট স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালাবে গাড়ি; তখন আর প্রয়োজন পড়বে না কোনো চালকের, তারা চাকরি হারাবে। এ অবস্থা দাঁড়াবে তখনকার মতো যখন বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি অফিসগুলোতে কম্পিউটার ব্যবহার শুরু হয়। তখন যারা কম্পিউটার চালাতে পারত না তাদের বেসরকারি কোম্পানি ছেঁটে ফেলত নিজেদের সুবিধার্থে। সামনের বিশ্বে মানুষের অনেক কাজ রোবটের দখলে থাকবে!
পশ্চিমা বিশ্ব এখন থেকেই চতুর্থ শিল্পবিপ্লব নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে। কিছু কিছু দেশে পরীক্ষামূলকভাবে কিছু কাজ রোবটকে দিয়ে করানো হচ্ছে; যেটা পরবর্তী সময়ে স্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অপরদিকে, আমরা বিশ্বে ইন্টারনেট সংযোগহীনতার শীর্ষে আছি। বৈশ্বিক গবেষণা সংস্থা স্ট্যাটিস্টার সম্প্রতি প্রকাশিত ‘ইন্টারনেট ইউজেস ওয়ার্ল্ডওয়াইডথ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে দেশে প্রায় ১০ কোটি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে। তবে বৈশ্বিক চিত্র বিবেচনায় বর্তমানে ইন্টারনেট সংযোগহীন জনগোষ্ঠীর শীর্ষ তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ।
প্রতিবেদনের প্রথম দেশ ভারত, দ্বিতীয় দেশ চীনা, তৃতীয় দেশ পাকিস্তান, চতুর্থ দেশ নাইজেরিয়া, পঞ্চম দেশ বাংলাদেশ। এছাড়া, ইন্টারনেট ব্যবহারের দিকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান নবম। বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৯ কোটি ৪২ লাখ। তবে, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) মতে, গত জুন শেষে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহাকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০ কোটি ৩৫ লাখ। এর মধ্যে মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ৯ কোটি ৪৯ লাখ বা প্রায় ৯২ শতাংশ। বাকিটা ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট।
এ ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ-সুবিধা কমতি থাকার কারণে আমরা প্রতিনিয়ত পিছিয়ে যাচ্ছি। বাংলাদেশে ফোরজি চালু থাকলেও নেটওয়ার্কের তেমন সুবিধা নেই। অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালু হলেও উচ্চ মূল্যের নেট প্যাকেজ এবং দুর্বল গতির ইন্টারনেটের কারণে অনেকে ক্লাসই করতে পারেনি! তবে, যাদের ব্রডব্যান্ড আছে কিংবা প্রযুক্তিগত সুযোগ-সুবিধা আছে তারা তাদের দক্ষতা উন্নয়ন করে আগামীর বিশ্বের নেতৃত্বের জন্য তৈরি হয়েছে। এছাড়া, শুধু একমুখী চাকরির চিন্তা ছেড়ে যে কেউ অন্য পেশায় যেতে পারবে এতে চাকরি স্থায়ী হবে কি না সে ভয় যেমন থাকবে না, তেমনি থাকবে নতুন নতুন চাকরির খাত।
তাই, বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নিতে ও বর্তমান তরুণদের একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে জরুরি প্রযুক্তিগত সুযোগ-সুবিধা ও তার যথাযথ ব্যবহার। এতে, বিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশের তরুণরা ও বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে পারবে।
শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়