পুষ্টি চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে কুল বা বরই। এর কয়েকটি বিষয় তুলে ধরা হলো
সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ঝাউডাঙ্গা ইউনিয়নের অমরাবতী গ্রামের মৃত পীর আলী মোড়লের ছেলে আনার আলী বাবু। এক সময় অন্যের জমিতে কৃষিশ্রমিক হিসেবে কাজ করে সংসার চালাতে হিমশিম খেতেন। সেসব দিন এখন অতীতÑকৃষিশ্রমিক থেকে এখন তিনি মালিক। তার খামারে কাজ করছেন শতাধিক শ্রমিক। এ বছর তিনি ৩৩ বিঘা জমিতে কুল চাষ করেছেন। বাড়িতে উঠেছে দোতলা ভবন। কিনেছেন প্রায় ২০ বিঘা ধানিজমি। সাতক্ষীরা-যশোর-খুলনা অঞ্চলে ‘কুল চাষ বিশেষজ্ঞ’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কুলচাষি তার কাছে আসেন পরামর্শ নিতে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে অনেকে আসেন তার বাগান পরিদর্শনে। সম্প্রতি এক আলাপচারিতায় বিষয়গুলো জানার চেষ্টা করেছেন ফারুক রহমান
আপনার তো নিজস্ব কোনো জমি ছিল না। কীভাবে কুলচাষে আগ্রহী হলেন?
আনার আলী বাবু: আর্থিক অসংগতির কারণে বাবা-চাচাদের মতো আমিও এলাকায় জোনের (কৃষি শ্রমিক) কাজ করতাম। এক পর্যায়ে এলাকার বাগান থেকে কুল কিনে ঢাকার কারওয়ান বাজারের আড়তে পাঠাতাম। কিন্তু বাগানে উৎপাদন ভালো না হওয়ায়, ভালো কুল না পাওয়ায় তা নষ্ট হয়ে যেত। প্রতিবছরই ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হতাম। এক সময় সিদ্ধান্ত নিই নিজেই কুলের বাগান করব। সেই থেকে শুরু।
কখন কুল চাষ শুরু করলেন, শুরুতে কত বিঘায় বাগান করেছিলেন?
আনার আলী: ২০০৬ সালে প্রথমে কয়েক বিঘা জমি লিজ নিয়ে কুল চাষ শুরু করি। বর্তমানে ৩৩ বিঘা জমিতে কুল চাষ করছি। একই সঙ্গে চলতি বছর ১০ বিঘা জমিতে পেয়ারা বাগান করেছি।
আপনার বাগানে প্রতিদিন কতজন শ্রমিক কাজ করেন?
আনার আলী: মৌসুমে দৈনিক ১০০, অন্য সময় প্রায় ৫০ শ্রমিক নিয়মিত কাজ করেন।
বাগান পরিচর্যায় কৃষি বিভাগ কি ধরনের পরামর্শ বা সহযোগিতা দেয়?
আনার আলী: কৃষি বিভাগ কুল চাষে কোনো সহযোগিতা করে না। কৃষি অফিসের লোকজন কুল চাষ সম্পর্কে তেমনকিছু জানেও না।
আপনি কোন জাতের কুল চাষ করছেন?
আনার আলী: আপেল ও নারিকেল কুল। ভবিষ্যতে অন্য জাত নিয়েও বাগান করার ইচ্ছা আছে।
আপনার বাগানে বিঘাপ্রতি উৎপাদন কত?
আনার আলী: ৮০ থেকে ১০০ মণ।
বিঘাপ্রতি কতটি কুলচারা রোপণ করেছেন?
আনার আলী: শুরুতে ১০০’র বেশি চারা রোপণ করেছিলাম। বর্তমানে ৩০ থেকে ৩৫টি চারা রেখেছি। বেশি গাছ থাকলে উৎপাদন ভালো হয় না। গাছ ঘন থাকলে গাছের যতœ নেওয়া যায় না, ফলনও কম হয়। গাছ ঘন থাকলে কুলের রঙ খারাপ হয়ে যায়।
সারা বছর কীভাবে বাগান পরিচর্যা করেন?
আনার আলী: মৌসুম শেষ হলে আমি অন্য চাষিদের মতোই ডাল কেটে দিই। তবে বাগানে অন্য কিছু চাষ করি না। ধাপে ধাপে বাগান পরিচর্যা করি।
উৎপাদিত কুল কোথায় বিক্রি করেন?
আনার আলী: স্থানীয় বাজারে খুচরা বিক্রি করি না। আমি প্রতিদিন বাগান থেকে ট্রাক লোড দিয়ে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে নির্দিষ্ট আড়তে পাঠাই।
সফল কুলচাষি হতে আপনার পরামর্শ কী?
আনার আলী: বাগানে গাছ কম রাখতে হবে। সারা বছর পরিচর্যা করতে হবে। কুলবাগানে কোনো সাথী ফসল লাগানো যাবে না। এতে মাটির গুণাগুণ কমে যায়। ফলে উৎপাদন বাড়ে না। সার্বক্ষণিক বাগানে তদারকি করতে হয়। যারা বাগানে শ্রমিক হিসেবে কাজ করবেন, তাদের নিয়মিত কুল চাষ সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। একই শ্রমিককে দিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করাতে হবে। প্রাকৃতিক সার ব্যবহারের ওপর জোর দিতে হবে।
বাগানের ওপর আন্তরিকতা তৈরিতে শ্রমিকদের কীভাবে উৎসাহিত করেন?
আনার আলী: আমার বাগানের শ্রমিকদের সব সময় আর্থিকভাবে সচ্ছল রাখার চেষ্টা করি। তাদের কোনো ধরনের ঋণগ্রস্ত হতে দিই না। এজন্য তাদের আর্থিকভাবে সহযোগিতা করি। যেটা তাদের পারিশ্রমিক থেকে সমন্বয় করা হয়।
কুল চাষ করে আর্থিকভাবে কেমন সচ্ছল হয়েছেন?
আনার আলী: এক সময় আমার ভিটেবাড়ি ছাড়া কিছুই ছিল না। অন্যের জমিতে কাজ করতাম। মাঠে কিছু ধানিজমি কিনেছি। বাড়িতে বিল্ডিং তৈরি করেছি। ব্যাংকে কিছু সঞ্চয় হচ্ছে নিয়মিত। একমাত্র ছেলেকে কুল চাষে সম্পৃক্ত করে তাকেও এগিয়ে নিচ্ছি।
কুল চাষে আগ্রহীদের উদ্দেশে আপনার পরামর্শ…
আনার আলী: প্রথমে কুল চাষ সম্পর্কে সঠিক ধারণা নিতে হবে। জমি নির্ধারণ করে সেখানে কুল চাষের উপযোগী করে মাটি প্রস্তুত করতে হবে। পরে যেতে হবে কুল চাষে।
সাতক্ষীরার কুল রফতানির ব্যাপারে আপনার কোনো আগ্রহ আছে কি-না?
আনার আলী: হ্যাঁ। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে ইতালি থেকে বিভিন্ন সময় ক্রেতারা আমার বাগান পরিদর্শন করেছেন। তারা আমার বাগানের কুল নিয়ে যেতে চাইছেন সে দেশে। কিন্তু সরকারি বিধিনিষেধের কারণে সম্ভব হয়নি। এছাড়া ইতালিতে আমাকেও নিয়ে যেতে চেয়েছে সেখানে বাগান তৈরির জন্য।
আপনি কি তাহলে কুল চাষ করতে বিদেশে চলে যাবেন?
আনার আলী: না। আমি দেশে থাকতে চাই। আমার জন্মস্থান সাতক্ষীরায় কুল চাষ আরও বাড়াতে চাই।