বিআইবিএমে সেমিনারে বক্তারা

একাধিক ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার প্রবণতায় বাড়ছে খেলাপির হার

নিজস্ব প্রতিবেদক: ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ জেঁকে বসেছে। কিছু গ্রহীতা ব্যাংকের কাছে চির ঋণী হওয়ার প্রবণতা দেখাচ্ছেন। তাদের কাছ থেকে ব্যাংক খাতকে মুক্ত করতে হবে। স্বভাবজাত খেলাপিদের কারণে ভালো গ্রাহকরাও নষ্ট হচ্ছেন। অন্যদিকে একই গ্রাহক বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে অধিক পরিমাণে। এটিও ঋণ খেলাপির হারকে উসকে দিচ্ছে। ফলে প্রতিনিয়ত বাড়ছে খেলাপি ঋণ বলে মতামত দিয়েছেন খাত বিশেষজ্ঞরা।

‘বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ; সামষ্টিক অর্থনীতি ও ব্যাংকের অবস্থান’ শীর্ষক সেমিনারে এমন মতামত দেন তারা। গতকাল অনুষ্ঠিত সেমিনারটির আয়োজন করে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম)। কভিড-১৯-এর কারণে অনলাইনে সেমিনারটি অনুষ্ঠিত হয়।

বিআইবিএমের মহাপরিচালক ড. মো. আখতারুজ্জামানের সভাপতিত্বে সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এসএম মনিরুজ্জামান। আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মাদ হুমায়ুন কবির, সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতাউর রহমান প্রধান, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ ওয়াসেক মোহা. আলী, বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র ফাইন্যান্সিয়াল সেক্টর স্পেশালিস্ট একেএম আবদুল্লাহ, ইডকলের নির্বাহী পরিচালক মাহমুদ মালিক।

সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিআইবিএমের সহযোগী অধ্যাপক মো. আলমগীর। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ভুল গ্রহীতাদের দেওয়া ঋণই খেলাপি হয়ে পড়ছে। অন্যদিকে গ্রাহকরা ঋণ নিয়ে অন্য খাতে ব্যয় করছেন। অথবা ভুল বিনিয়োগ পরিকল্পনা নেওয়ায় গ্রাহকরা অর্থ ফেরত দিতে পারছেন না। অনেকেই ব্যবসা সম্পর্কে অভিজ্ঞতা না থাকলেও ব্যাংক ঋণে শুরু করছেন। আবার ভালো গ্রাহকদের পেছনে সব ব্যাংক ছুটছে। এতেও গ্রাহকরা বেশি ঋণ নিচ্ছেন; যা অনেক ক্ষেত্রেই খেলাপি হয়ে পড়ছেন।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে মনিরুজ্জামান বলেন, সার্ক দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের ঋণখেলাপির হার তুলনামূলক কম। খেলাপি ঋণের পরিমাণ ও হার বাংলাদেশে গ্রহণযোগ্য মাত্রায় নামিয়ে আনা সম্ভব। ব্যাংক যখন ঋণ দেয়, তখন সব ঋণই কিন্তু ভালো থাকে। সময়ের পরিবর্তনে এটি খেলাপি হয়ে পড়ে। খেলাপি কমিয়ে আনতে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা পর্ষদকে উদ্যোগী হতে হবে। অবশ্য খেলাপি বৃদ্ধির আরেকটি কারণ হচ্ছে, রাজনৈতিক গোলযোগ ও অনিশ্চয়তা। এতে অনেকেই বিনিয়োগ নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভোগে।

তিনি আরও বলেন, এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকার প্রয়োজনীয় নীতিমালা তৈরির কাজ করছে। ব্যাংকিং নীতিমালা অনুযায়ী বন্ধকের বিপরীতে ঋণ প্রদান করা হয়ে থাকে। কিন্তু জামানত রেখেই যে ঋণ দিতে হবে; তা নয়। আমরা এ সুযোগও রেখেছি জামানতবিহীন ঋণ বিতরণের। ব্যাংক দেখবে কোন গ্রাহককে কতটুকু বিশ্বাস করবে।

আজকের প্রবন্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে। তা হলো একই গ্রাহক বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে। এর পরিমাণও বাড়ছে। এটি খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির জন্য সহায়ক হয়ে উঠছে। কিন্তু অনেক ব্যাংকই একক গ্রাহক সর্বোচ্চ সীমা মানতে গিয়ে চাহিদা অনুযায়ী ঋণ দিতে পারে না। তখন গ্রাহককে বাধ্য হয়ে অন্য ব্যাংকে যেতে হয়। কিন্তু ব্যাংককেও দেখতে হবে কী পরিমাণ ঋণ দেওয়া যেতে পারে। ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদন ঠিক রাখতে গিয়ে রাইট অফ করতে হয়। এটি করা প্রয়োজন। এর মানে কিন্তু এটি নয়, এ ঋণ একেবারেই আদায় হবে না বলেও মতামত দেন তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মাদ হুমায়ুন কবির বলেন, ১৯৮৯ সালের পূর্ব পর্যন্ত আমরা খেলাপির ঋণের বিষয়ে জানতামই না। ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ হচ্ছে কিন্তু জানা যেত না। এখন আমরা জানতে পারছি। বর্তমানে কিছু গ্রাহক ব্যাংকের কাছে চির ঋণী হওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এভাবে পুঞ্জীভূত ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। এটি টেনে চলতে হয় বছরের পর বছর। এদের থেকে ব্যাংক খাতকে মুক্ত হতে হবে। যতদিন না মুক্ত হবো, ততদিন খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমবে না। আমি মনে করি, খেলাপি হওয়াদের মধ্যে অধিকাংশই ঋণ পরিশোধে সক্ষম। ঋণ পরিশোধ করতে পারবে না, এমন গ্রাহক খুবই কম।

আলোচনায় অংশ নিয়ে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতাউর রহমান বলেন, গ্রাহককে অভারফ্লো বা অতিরিক্ত ঋণ দেওয়ার কারণেই খেলাপি হয়ে পড়ছে। এতে গ্রাহক ও ব্যাংক উভয়ই সমস্যায় পড়ে। এটি কমানো প্রয়োজন। এতে ভালো গ্রাহকরাও ইচ্ছেকৃত খেলাপি হয়ে পড়ছেন।

সৈয়দ ওয়াসেক মোহা. আলী বলেন, ‘অনেক সময় ভালো গ্রাহককেই গুরুত্ব দিই বেশি করে। সব ব্যাংকই তাদের কাছে যায়। এতে কিছু ভালো গ্রাহক প্রয়োজনের চেয়েও বেশি ঋণ নিচ্ছেন। এতে এক সময়ে তা খেলাপি হয়ে পড়ছেন। কিন্তু ঋণ দেওয়ার পরে সব গ্রাহককেই পর্যবেক্ষণ, তদারকি করা প্রয়োজন। এটি হচ্ছে না। এতেও খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে।’

সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘এখন ভালো গ্রাহকরাও খেলাপি হয়ে পড়ছেন। কারণ হচ্ছে, ভালোদের পেছনে ব্যাংক ছুটছে। নতুন সুবিধা পাওয়ায় তিনিও ঋণ নিচ্ছেন। কিন্তু ঋণ গ্রহীতাদের ভালো হিসাববিদ নেই। ফলে তারা জানছেন না কোম্পানিতে কী পরিমাণ অর্থের সরবরাহ হচ্ছে। কোন ব্যাংকের ঋণ আগে পরিশোধ করতে হবে। এজন্য পেশাগতভাবে ব্যাংকগুলোকে পর্যবেক্ষণ বাড়াতে হবে।’

বিআইবিএমের সহযোগী অধ্যাপক আশরাফ আল-মামুনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত সেমিনারটিতে সভাপতির বক্তব্যে ড. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘সামষ্টিক অর্থনীতিতে খেলাপি ঋণের নেতিবাচক প্রভাব কীভাবে পড়ছে তার একটি ধারণা পাওয়া যাচ্ছে। সুদহার খেলাপি ঋণের ওপর তেমন কোনো প্রভাব রাখছে না। অন্যান্য দেশেও খুব একটা প্রভাব পড়ে না। খেলাপি হওয়ার জন্য অন্য ফ্যাক্টরগুলো বেশি কাজ করে।’

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০