Print Date & Time : 18 June 2025 Wednesday 10:16 pm

যানজট পেছনে ফেলে বিমানবন্দর থেকে যাত্রাবাড়ী

পিপিপিতে এটি নির্মাণে ৬৫ শতাংশ অর্থের জোগান দেবে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ইটালিয়ান-থাই ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড। বাকি ৩৫ শতাংশ অর্থ ভায়াবিলিটি গ্যাপ ফান্ড হিসেবে সরবরাহ করবে বাংলাদেশ সরকার। ২০১৯ সালে পুরো এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে

ইসমাইল আলীঢাকা এখন যানজটের শহর। বিভিন্ন সমীক্ষায় তা শীর্ষ কয়েকটি শহরের সংক্ষিপ্ত তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। সকাল হোক বা দুপুর, সন্ধ্যা হোক কি রাত যানজট থেকে মুক্তি নেই রাজধানীবাসীর। চট্টগ্রাম থেকে বিমানে ঢাকায় আসা যায় মাত্র আধা ঘণ্টায়। অথচ বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত যেতে সময় লাগে তিন থেকে চার ঘণ্টা। এমনকি ছুটির দিনেও এ যানজট থেকে মুক্তি নেই রাজধানীবাসীর।

যানজট কমানোর জন্য মহাখালী, খিলগাঁও, কুড়িল-বিশ্বরোড, মিরপুর-বিমানবন্দর সড়ক ও যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান রুটে নির্মাণ করা হয়েছে পাঁচটি ফ্লাইওভার। তবে যানজট থেকে মুক্তি মেলেনি। কখনো ফ্লাইওভার থেকে নামলে পড়তে হয় যানজটে। আবার যানজটের কারণে অনেক সময় ফ্লাইওভারের ওপরেই বসে থাকতে হয়। তাই এ শহরের যানজট কমাতে উড়ালপথে (এলিভেটেড) এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ শুরু করেছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। দেশের প্রথম এ এক্সপ্রেসওয়ের নাম দেয়া হয়েছে ‘ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে’।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এক্সপ্রেসওয়েটি নির্মাণ হলে বদলে যাবে ঢাকা চিত্র। দেখা যাবেÑ এতটুকু যানজট নেই, দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে যানবাহন। নিচে দেখা যায় শহর। শহরকে নিচে ফেলে, যানজটকে পেছনে রেখে ১০০ বা ১২০ কিলোমিটার গতিতে ছুটে যাবে যানবাহন। অনেকটা হলিউড-বলিউডের সিনেমায় দৃশ্যের মতো।

বিদেশে গিয়ে হয়তো অনেকেই চলেছেন এক্সপ্রেসওয়ে ধরে। তবে ঢাকার শহরে এ ধরনের এক্সপ্রেসওয়ে হবে এটা অনেকের কাছেই ছিল কল্পনার মতো। সেই কল্পনাকে বাস্তবায়নের পথ ধরে শুরু হয়েছে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের কাজ। ২০১৫ সালের অক্টোবরে এর নির্মাণকাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। বর্তমানে এক্সপ্রেসওয়ের ১০০টি পাইলিং সম্পন্ন হয়েছে বলে জানা গেছে। ভূমির ওপরে উঠে গেছে ১২টি পিলারও।

এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের অর্থ জোগাড়েও অনুসরণ করা হচ্ছে নতুন পদ্ধতি। সরকারি বেসরকারি অংশীদারিত্বে (পিপিপি) এটি নির্মাণে ৬৫ শতাংশ অর্থের জোগান দেবে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ইটালিয়ান-থাই ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড। বাকি ৩৫ শতাংশ অর্থ ভায়াবিলিটি গ্যাপ ফান্ড হিসেবে সরবরাহ করবে বাংলাদেশ সরকার।

এটি নির্মাণসম্পন্ন হলে বিমানবন্দর থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত যেতে সময় লাগবে সর্বোচ্চ ৩০ মিনিট। পুরো শহরের যানজট এড়িয়ে চলে যাওয়া যাবে এর ওপর দিয়ে।

যদিও এক্সপ্রেসওয়েটির কাজ শুরু খুব একটা সহজ ছিল না। জমি অধিগ্রহণের জটিলতা এড়াতে তিন দফা নকশা পরিবর্তন করা হয়। আবার বিমানবন্দরের নিরাপত্তার কারণে এর কিছু অংশের উচ্চতা কমাতে হয়। তবে এক্সপ্রেসওয়েটির রুটের মধ্যে রয়েছে ৫টি ফ্লাইওভার। এজন্য এক্সপ্রেসওয়ের উচ্চতার কথাটিকেও মাথায় রেখেই নকশা চূড়ান্ত করতে হয়। আবার এক্সপ্রেসওয়ের পুরো রুটের অর্ধেক অংশই নির্মাণ করতে হবে কমলাপুর-বিমানবন্দর রেলপথের ওপর। এ রেলপথটিও দুই লাইন থেকে চার লাইনে সম্প্রসারণের কাজ চলছে। এজন্য ভূমিতেও প্রয়োজনীয় অংশ ছেড়ে দিতে হয় পাইলিং ও পিলারের নকশা করতে গিয়ে। পরে বক্সগ্রিডার থেকে আইগ্রিডারে রূপান্তর করা হয় এক্সপ্রেসওয়েটির নকশা। রেলওয়ের সঙ্গে নকশার সমন্বয়ের কাজ এখনু চলছে।

এ ছাড়া আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করতে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও করতে হয়। আর বিশ্বমন্দার মাঝে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে প্রয়োজনীয় অর্থায়ন সংগ্রহে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান।

এর আগে এক্সপ্রেসওয়ের সম্ভাব্যতা যাচাইওয়েও কয়েক দফা রুট পরিবর্তন করতে হয়। প্রাথমিকভাবে এটি ঢাকার বাইরে দিয়ে অতিক্রমের জন্য সম্ভাব্য রুট চূড়ান্ত করে সমীক্ষা পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান নেদারল্যান্ডসের বিশ্বখ্যাত কোম্পানি এইকম। তবে পিপিপিতে বিনিয়োগ আকর্ষণের পরে তিন দফা সম্ভাব্য রুট পরিবর্তন করে এটিকে আনা হয় ঢাকার ভেতর দিয়ে। এর ফলে ঢাকা ভেতরের যাত্রীরাও সহজেই এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করতে পারবেন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

এতসব জটিলতার কারণে নির্ধারিত সময়ের ৫ বছর পর নির্মাণ শুরু করা হয় এক্সপ্রেসওয়েটি। ২০১১ সালের জুনে নির্মাণ শুরুর সম্ভাব্য সময় ধরা হলেও পরে তা কয়েক দফা পেছানো হয়। প্রথম জটিলতা তৈরি হয় বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের অর্থায়ন সংগ্রহ নিয়ে। এরপর আসে বিমানবন্দরের নিরাপত্তার বিষয়টি। এজন্য আপত্তি তোলে সিভিল অ্যাভিয়েশন অথরিটি। পরে জমি অধিগ্রহণ জটিলতা।

নির্মাতা প্রতিষ্ঠান সেতু কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, এক্সপ্রেসওয়েটি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কুড়িল, বনানী, মহাখালী, সাতরাস্তা, মগবাজার ও কমলাপুর হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাছে কুতুবখালী গিয়ে শেষ হবে। তবে কমলাপুরের পরের অংশটি নির্মাণে ৪৩৬ একর জমি অধিগ্রহণ করতে হতো। এজন্য ভাঙতে হতো কয়েকশ বাড়িঘর। এ নিয়ে আপত্তি তোলেন খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, এত মানুষের ক্ষতি করে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ চলবে না। এজন্য নকশা পরিবর্তনের নির্দেশনা দেন। প্রয়োজনে গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের সঙ্গে এক্সপ্রেসওয়েটিকে যুক্ত করার পরামর্শও দেন তিনি।

তবে গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভার নির্মাণ প্রায় শেষ দিকে থাকায় এটির সঙ্গে এক্সপ্রেসওয়ে সংযোগ করা সম্ভব হয়নি। আবার দুইটি প্রকল্পের জন্য টোল দিতে

হবে। এটিও জটিলতা সৃষ্টি করে। পরে সেটিকে পরিবর্তন করে কমলাপুর থেকে অতীশ দীপঙ্কর সড়ক ধরে গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে গিয়ে কুতুবখালী শেষ হবে এক্সপ্রেসওয়েটি। এটি নির্মাণে নিয়োগ দেয়া হয়েছে ভারতের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিমপ্লেক্স ইনফ্রাসট্রাকচার।

র‌্যাম্পসহ ঢাকা এক্সপ্রেসওয়েটির দৈর্ঘ্য ৪৬ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। এক্সপ্রেসওয়েটির সঙ্গে দুটি উড়াল সংযোগ সড়ক নির্মাণের প্রস্তাব ছিল। এর মধ্যে পলাশী থেকে কাঁটাবন, সোনারগাঁও হোটেল হয়ে মগবাজার রেলক্রসিং পর্যন্ত সংযোগ উড়াল সড়ক রয়েছে। তবে মেট্রোরেলের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় মানিক মিয়া এভিনিউ থেকে ফার্মগেট হয়ে তেজগাঁওয়ে গিয়ে মূল এক্সপ্রেসওয়েতে যুক্ত হওয়ার অংশটি বাতিল করা হয়।

নকশা চূড়ান্তের পর সংশোধন করা হয় প্রকল্পটি। এরপর কুড়িল-বিশ্বরোড এলাকায় জমি অধিগ্রহণ করা হয়। আর এতে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে নেওয়া হয় পৃথক প্রকল্প। সাপোর্ট টু ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে শীর্ষক প্রকল্পটিতে  এ জন্য ব্যয় করা হচ্ছে ৪ হাজার ৮৮৫ কোটি ৪১ লাখ টাকা। আর মূল এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ১৩ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ইতালিয়ান থাই ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি বিনিয়োগ করবে ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। আর ভায়াবিলিটি গ্যাপ ফান্ড (ভিজিএফ) হিসেবে ২ হাজার ৪১৪ কোটি টাকা দেবে সরকার। প্রথম অংশের কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর ছয় কিস্তিতে এ অর্থ দেয়া হবে।

প্রকল্প পরিচালক কাজী মোহাম্মদ ফেরদৌস শেয়ার বিজকে বলেন, সব জটিলতা পেরিয়ে অবশেষে শুরু হয়েছে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণকাজ। প্রথম অংশের কাজ আগামী বছরের মধ্যে শেষ হবে। আর ২০১৯ সালে পুরো এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।

তিনি আরও জানান, ঢাকা শহরের জন্য প্রণীত স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্যানে (এসটিপি) যে এক্সপ্রেসওয়ের কথা বলা হয়েছে, এটি তার একাংশ। তাই এটি উত্তরে জয়দেবপুর চৌরাস্তা ও দক্ষিণে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত সম্প্রসারণের সুযোগ রাখা হয়েছে। এই উড়ালসড়ক তৈরি হলে ঢাকার রাস্তায় গাড়ির চাপ এবং যানজট অনেক কমে যাবে।

উল্লেখ্য, প্রথম ধাপে বিমানবন্দর সড়ক থেকে নির্মাণ করা হবে মহাখালী পর্যন্ত। দ্বিতীয় ধাপে কমলাপুর ও শেষ ধাপে নির্মাণ করা হবে কুতুবখালী পর্যন্ত।

প্রকল্প এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, বিমানবন্দর থেকে কুড়িল পর্যন্ত চলছে পাইলিংয়ের কাজ। এ ছাড়া ভূ-গর্ভস্থ পরিষেবা সংযোগ লাইন স্থানান্তরের কাজ করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর স্পেশাল ওয়ার্কস ডিভিশন। ১০০টি পাইলিং সম্পন্ন হয়েছে। আর ১২টি পিলার নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে।

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে যানবাহন চলাচলে দিতে হবে টোল। প্রাথমিকভাবে টোল ধরা হয়েছে গাড়িতে ১২৫ টাকা, যাত্রীবাহী বাসে ২৫০ টাকা, ৬ চাকার ট্রাকে ৫০০ টাকা আর ৬ চাকার বেশি ট্রাকের জন্য ৬২৫ টাকা। তবে তিন বছর পর পর টোলের হার সমন্বয় করা হবে। এক্সপ্রেসওয়ে থেকে ২৫ বছর টোল আদায় করবে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান।