Print Date & Time : 18 June 2025 Wednesday 2:12 am

এক টুকরো নারী রাজ্য

গ্রামটির নাম পশ্চিম আমখাওয়া। জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার সীমান্তবর্তী হাতিভাঙ্গা ইউনিয়নের প্রত্যন্ত একটি গ্রাম। বেশিদিন আগের কথা নয়, পাঁচ থেকে সাত বছর আগেও এ গ্রামের নারীরা পুরুষ দেখলেই ঘোমটা টেনে চলত, মুখে আনত না স্বামীর নাম। অথচ বর্তমানে ব্যবসা থেকে শুরু করে বাজার পরিচালনা কমিটি সবকিছুর নেতৃত্ব রয়েছে নারীরা। বাজারটির দৃশ্যপট দেখে মনে হতে পারে পুরুষশাসিত সমাজে এ যেন এক খণ্ড নারী রাজ্য!
গ্রামের একজন নারী শেফালী বেগম কয়েক বছর আগেও স্বামীর সঙ্গে মাঠে কৃষিকাজ করতেন। সে সময় সংসারে অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী। পুরুষদের দেখলেই লম্বা ঘোমটা টেনে চলতেন, স্বামীর নাম জিজ্ঞাসা করলে মুখে নিতেন না তার নাম। সেই শেফালী বেগমই আজ আমখাওয়া বাজারে বসে ব্যবসা করছেন। ব্যবসার টাকায় সংসারে শুধু সচ্ছলতাই ফিরিয়ে আনেননি, কিনেছেন জমি, করেছেন বাড়ি। বাজারের এক দোকান থেকে হয়েছে তিনটি দোকান। এখন আর অন্যের করুণায় চলতে হয় না তাকে।
একই বাজারের আনোয়ারা বেগমের বিয়ে হয় এক কাঠমিস্ত্রির সঙ্গে বাল্য বয়সে। অভাবের সংসারে তার নুন আনতে পানতা ফুরোতো। তাই সংসারের সচ্ছলতা ফেরাতে নারী হিসেবে তিনিই প্রথম এ বাজারে ব্যবসা শুরু করেন। সে সময় লোকজনের নানা ধরনের কথা শুনেও হাল ছাড়েননি। শেফালী আর আনোয়ারাই ননÑএ বাজারের আম্বিয়া খাতুন, রুমা আক্তার, কামিনা আক্তার, মাজেদা বেগমসহ সব নারীই যেন এক একটি সাফল্যের গল্প।
সাফল্যের পেছনের কারিগর গণচেতনা রি-কল নামের একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা। আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে সংস্থাটি গ্রামের ১৮ নারীকে ব্যবসার ওপর প্রশিক্ষণ দেয়। পরে এককালীন অনুদানের মাধ্যমে বাজারে দোকান করে দেয়। তাদের দেখাদেখি অন্যান্য নারীও নিজ উদ্যোগে এ বাজারে দোকান দিয়েছেন। বর্তমানে বাজারের ৫০টি দোকানের ৩২টির ব্যবসায়ী নারী। হোটেল, কসমেটিকস, মনোহারী, লেপ-তোশক, কম্পিউটার-ফটোকপিয়ারসহ সব ধরনের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তারা।
রুমা আক্তার বলেন, ‘আমি এ বাজারে কম্পিউটার-ফটোস্ট্যাটের দোকান দিছি; আমার স্বামীও পাশের আরেকটি বাজারে এইগুলার দোকানি। আমি মানুষের ছবি তুলি, ছবি প্রিন্ট দিই, গান ডাউনলোড, ফটোকপি করি। প্রতিদিন আমাদের দুইজনের যা আয় হয়, তাতে সংসার অনেক ভালোভাবে চলতাছে।’
কসমেটিকস ব্যবসায়ী রিনা বলেন, ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালক স্বামীর একার রোজগারে কোনোরকমে সংসার চলছিল। বাজারের নারীদের ব্যবসা করতে দেখে পাঁচ বছর আগে রি-কলের অনুদান আর স্বামীর কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে ব্যবসা শুরু করি। এ ব্যবসা করে এখন জমি কিনে পাকা বাড়ি করেছি, স্বামীকে নতুন মোটরসাইকেল কিনে দিয়েছি। সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে ব্যাংকেও টাকা জমাচ্ছি। আমার সংসারে এখন কোনো অভাব নেই। বাজারের তিনটি হোটেলের মালিক তিনজন নারী। নাছিমা, ছমিরুন আর জোস্না হোটেল ব্যবসা করে তাদের পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতাই শুধু ফিরিয়ে আনেননি, পরিবারের অন্য সদস্যদেরও কর্মসংস্থানের পথ সৃষ্টি করেছেন। হোটেল ব্যবসায় এ তিন নারীকে সহায়তা করছেন তাদের স্বামী-সন্তানরা।
বাজার পরিচালনা কমিটির নেতৃত্বও দিচ্ছেন বাজারের নারীরা। বাজার পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক কনিকা পারভীন জানান, বাজারের ব্যবসা থেকে শুরু করে কমিটি পরিচালনাÑসবকিছুই নারীরা করছে। তাই আমাদের বাজারটি এখন নারী বাজার হিসেবে সবাই চেনেন।
গণচেতনা রি-কল প্রকল্পের সমন্বয়কারী শ্যামল রায় জানান, যমুনার দুর্গম এলাকার নারীদের স্বাবলম্বী করার চেষ্টা করছি। ব্যবসা কীভাবে পরিচালনা করতে হয়, প্রথমে সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পর আর্থিক অনুদান দিয়ে এসব নারীকে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান করে দেওয়া হয়েছে। তৃণমূল পর্যায়ে নারীর ক্ষমতায়নের এক অনন্য উদাহরণ হতে পারে নারী পরিচালিত এ বাজারটি।

সৌরভ আবিদ, জামালপুর