বিশেষ প্রতিনিধি: আন্তর্জাতিক বাজারে লম্বা সময় ধরে জ্বালানি তেলের দাম নিন্মমুখী থাকলেও দেশের বাজারে কমানো হয়নি। এতে সাত বছর উচ্চহারে মুনাফা করেছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। ২০২০-২১ অর্থবছর তা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। তবে ২০২১ সাল থেকে বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়তে শুরু করলে লোকসানে পড়ে বিপিসি। এজন্য গত বছর তেলের দাম রেকর্ড পরিমাণ বাড়ানো হয়। এরপরও চলতি অর্থবছর বড় ধরনের লোকসান গুনতে যাচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত তেলের একমাত্র আমদানিকারক ও বিপণনকারী সংস্থাটি।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা, ২০২৩’-এ রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন সংস্থার অর্থবছরভিত্তিক মুনাফা/লোকসানের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এতে বিপিসির লোকসানের চিত্র উঠে এসেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর মধ্যে চলতি অর্থবছর বিপিসি সর্বোচ্চ লোকসান করছে বলে সমীক্ষায় দেখানো হয়েছে।
অর্থনৈতিক সমীক্ষার তথ্যমতে, বিপিসির ইতিহাসে সর্বোচ্চ লোকসান ছিল ২০১১-১২ অর্থবছরে। ওই বছর সংস্থাটি লোকসান গুনে ১১ হাজার ৩৭১ কোটি ৩১ লাখ টাকা। এছাড়া ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ৯ হাজার ৫৫৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ও ২০১০-১১ অর্থবছর আট হাজার ৮৪০ কোটি ৪৬ লাখ টাকা লোকসান দেয় বিপিসি। তবে ২০১২-১৩ ও ২০১৩-১৪ অর্থবছরে লোকসান কমে সংস্থাটির। ওই দুই অর্থবছর বিপিসির লোকসান ছিল যথাক্রমে চার হাজার ৮৩২ কোটি ৩৬ লাখ টাকা ও দুই হাজার ৩২১ কোটি ৩৩ লাখ টাকা।
আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমে আসায় এরপর টানা সাত বছর মুনাফা করেছে সংস্থাটি। এর মধ্যে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বিপিসি মুনাফা করে চার হাজার ১২৩ কোটি আট লাখ টাকা। পরের অর্থবছর তা আরও বেড়ে হয় ৯ হাজার ৪০ কোটি সাত লাখ টাকা এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছর আট হাজার ৬৫৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা। তবে উচ্চ মুনাফার পরও দেশের বাজারে জ্বালানি তেলের দাম না কমানোয় সমালোচনার মুখে পড়ে সরকার। এতে অনেকটা বাধ্য হয়ে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম কমানো হয় ২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল।
এর প্রভাবে পরের অর্থবছর বিপিসির মুনাফা কিছুটা হ্রাস পায়। এতে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পাঁচ হাজার ৬৪৪ কোটি ৩৭ লাখ টাকা মুনাফা করে বিপিসি। ২০১৮-১৯ অর্থবছর তা আরও কিছু কমে দাঁড়ায় চার হাজার ৭৬৮ কোটি ৪২ লাখ টাকা। তবে করোনার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমতে শুরু করে। এতে ২০১৯-২০ অর্থবছর বিপিসির মুনাফা কিছুটা বেড়ে হয় পাঁচ হাজার ৬৬ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। আর ২০২০-২১ অর্থবছর তা রেকর্ড ৯ হাজার ৫৫৯ কোটি ৪৫ লাখ টাকায় পৌঁছায়।
এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়তে শুরু করলে গত অর্থবছরের শুরু থেকে ডিজেলে লোকসান গুনতে শুরু করে বিপিসি। এতে ২০২১ সালের ৪ নভেম্বর ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়ানো হয়। ওই অর্থবছর ফার্নেস অয়েলের দামও ছয়বার বাড়ানো হয়। পাশাপাশি জেট ফুয়েল ও মেরিন ফুয়েলের দাম বাড়ানো হয় বেশ কয়েকবার। এরপরও আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে থাকায় ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে সব ধরনের তেলে লোকসান গুনতে শুরু করে বিপিসি।
এর পরিপ্রেক্ষিতে গত আগস্টে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম রেকর্ড পরিমাণ বাড়ানো হয়। ফলে গ্রাহক পর্যায়ে প্রতি লিটার ডিজেল ও কেরোসিনের খুচরা মূল্য দাঁড়ায় ১১৪ টাকা, পেট্রোল ১৩০ টাকা ও অকটেন ১৩৫ টাকা। তবে আমদানি পর্যায়ে শুল্ক কমানোর কারণে কিছুটা লোকসান কমে বিপিসির। এতে ওই মাসেই সব ধরনের তেলের দাম পাঁচ টাকা হারে কমানো হয়। এরপরও ডিজেলে বড় অঙ্কের লোকসান গুনছে বিপিসি। তবে অকটেনে কিছু মুনাফা করে সংস্থাটি। তবে বিপিসি বিক্রি করা জ্বালানি তেলের মধ্যে ডিজেলের পরিমাণই প্রায় ৮০ শতাংশ। এতে সংস্থাটি লোকসান কমানো যায়নি।
এর পরিপ্রেক্ষিতে গত এপ্রিল পর্যন্ত সাত হাজার ৮৭ কোটি ৭০ লাখ লোকসান গুনে বিপিসি। যদিও জ্বালানি তেলে ভর্তুকি প্রত্যাহারের বিষয়ে বিবেচনা করছে সরকার। এজন্য নতুন নীতিমালা করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দেশে জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণ করা হবে। প্রতি তিন মাসে একবার করে তেলের দাম সমন্বয় করা হবে। এটি বাস্তবায়ন হলে বিপিসির মুনাফা বা লোকসান প্রায় শূন্য হয়ে যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে দুর্নীতি ও অনিময় কমানো গেলে বিপিসির লোকসান এখনই কমানো সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

Print Date & Time : 22 June 2025 Sunday 1:44 pm
এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ লোকসানের মুখে বিপিসি
শেষ পাতা ♦ প্রকাশ: