Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 12:51 am

এক দশকে সামিটের পকেটে সাত হাজার ৬৯০ কোটি টাকা

বেসরকারি খাতে স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা প্রতি বছর বাড়ছে। এতে বাড়ছে ক্যাপাসিটি চার্জের বোঝাও। গত এক দশকে শুধু এ চার্জ থেকেই প্রচুর আয় করেছে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ এক দশকে কোন কোম্পানি কত আয় করেছে, তা সম্প্রতি অনুসন্ধান করেছে শেয়ার বিজ। এ নিয়ে ধারাবাহিক আয়োজনের আজ ছাপা হচ্ছে দ্বিতীয় পর্ব

ইসমাইল আলী: বেসরকারি খাতে বর্তমানে একক বৃহৎ বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সামিট। এ গ্রুপের ৮টি কেন্দ্রের বর্তমান বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা এক হাজার ৪৩৫ মেগাওয়াট, যা বেসরকারি খাতে স্থাপিত সক্ষমতার প্রায় ১৭ শতাংশ। যদিও চাহিদা না থাকায় কেন্দ্রগুলো বছরের বড় সময়ই বসে থাকে। তবে বেসরকারি খাতে নির্মিত এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য নিয়মিতই ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হয় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি)।

সংস্থাটির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এক দশকে সামিট গ্রুপের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য পিডিবিকে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছে প্রায় সাত হাজার ৬৯০ কোটি টাকা, যা এক দশকে এ খাতে ব্যয়ের ১২ দশমিক ৯০ শতাংশ। কোম্পানিভিত্তিক ক্যাপাসিটি চার্জ আদায়ের তালিকায় বর্তমানে সামিটই শীর্ষে রয়েছে।

তথ্যমতে, ২০১০-১১ অর্থবছর মাত্র দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র ছিল সামিট গ্রুপের। এগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ১৩৫ মেগাওয়াট। এর একটি সামিট পূর্বাঞ্চল। গ্যাসচালিত এ কেন্দ্রটির উৎপাদন সক্ষমতা ৩৩ মেগাওয়াট। আর ফার্নেস অয়েলচালিত সামিট নারায়ণগঞ্জ কেন্দ্রটির উৎপাদন সক্ষমতা ১০২ মেগাওয়াট। এ দুই কেন্দ্রের জন্য ওই অর্থবছরে পিডিবির ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয় মাত্র ৬৩ কোটি ৬১ লাখ টাকা।

পরের দুই অর্থবছরও সামিটের দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রই উৎপাদনে ছিল। তবে উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় কেন্দ্র দুটি থেকে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ আয় বৃদ্ধি পায় সামিটের। এর মধ্যে ২০১১-১২ অর্থবছরে পিডিবিকে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয় ১৯৫ কোটি ৭৬ লাখ টাকা ও ২০১২-১৩ অর্থছরে ১৯৩ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। যদিও ওই সময়ে আরও কয়েকটি কেন্দ্র নির্মাণাধীন ছিল কোম্পানিটির।

এর মধ্যে ২০১৩-১৪ বছরের শেষ দিকে মেঘনাঘাট কেন্দ্রের (২০৩ মেগাওয়াট) সিম্পল সাইকেল উৎপাদন শুরু করে। এতে ওই অর্থবছর সামিটের কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৩৩৮ মেগাওয়াট। আর সে বছর পিডিবিকে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয় ২০৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা। তবে মেঘনাঘাট কেন্দ্রটি পরের অর্থবছর কম্বাইন্ড সাইকেলে ও পূর্ণ ক্ষমতায় উৎপাদন শুরু করে।

২০১৪-১৫ অর্থবছর সামিট মেঘনাঘাট বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়ায় ৩৫৫ মেগাওয়াট। ডুয়েল ফুয়েল হলেও গ্যাসের সরবরাহ না থাকায় শুরু থেকেই এটি ডিজেলে চালানো হচ্ছিল। এছাড়া ওই অর্থবছর শেষ দিকে উৎপাদনে আসে ৩৪১ মেগাওয়াটের বিবিয়ানা-২ কেন্দ্রটি। যদিও গ্যাসচালিত এ কেন্দ্রটি পূর্ণোদ্যমে উৎপাদন শুরু করে পরের অর্থবছর। তবে ২০১৪-১৫ অর্থবছর সামিটের উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়ায় ৮১১ মেগাওয়াট। এর বিপরীতে পিডিবিকে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয় ৩৭১ কোটি ২৭ লাখ টাকা।

এর পরের অর্থবছর মদনগঞ্জ ও বরিশালে সামিটের আরও দুটি কেন্দ্র উৎপাদনে আসে। এগুলোর সক্ষমতা ছিল যথাক্রমে ৫৫ ও ১০০ মেগাওয়াট। উভয় কেন্দ্রই ছিল ফার্নেস অয়েলচালিত। এতে ২০১৫-১৬ অর্থবছর সামিটের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়ায় ৯৮৬ মেগাওয়াট। আর ওই অর্থবছর পিডিবিকে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয় ৯১৫ কোটি ৩৭ লাখ টাকা।

২০১৬-১৭ অর্থবছরও কোম্পানিটির উৎপাদন সক্ষমতা একই ছিল। তবে উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় ওই বছর সামিটের ক্যাপাসিটি চার্জ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় এক হাজার ১০২ কোটি ৯ লাখ টাকা। পরের অর্থবছর উৎপাদনে আসে সামিটের গাজীপুর-২ কেন্দ্রটি। ফার্নেস অয়েলচালিত এ কেন্দ্রটির উৎপাদন সক্ষমতা ৩০০ মেগাওয়াট। এতে ২০১৭-১৮ অর্থবছর সামিটের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় এক হাজার ২৮৬ মেগাওয়াট। তবে উৎপাদন কমে হওয়ায় ওই অর্থবছর ক্যাপাসিটি চার্জ কিছুটা কমে দাঁড়ায় এক হাজার ১০০ কোটি ২৩ লাখ টাকা।

এদিকে ২০১৮-১৯ অর্থবছর উৎপাদনে আসে সামিটের এসিই অ্যালায়েন্স কেন্দ্রটি। নারায়ণগঞ্জে অবস্থিত ফার্নেস অয়েলচালিত এ কেন্দ্রটির উৎপাদন সক্ষমতা ১৪৯ মেগাওয়াট। এছাড়া গত অর্থবছর জাতীয় গ্রিডে এলএনজি যুক্ত হওয়ার পর মেঘনাঘাট কেন্দ্রটিতে গ্যাসে উৎপাদন শুরু করা হয়। সে অর্থবছর সামিটের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়ায় এক হাজার ৪৩৫ মেগাওয়াট। আর এসব কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ পিডিবিকে পরিশোধ করতে হয় এক হাজার ৬৮৮ কোটি ৯৩ লাখ টাকা।

২০১৯-২০ অর্থবছরও সামিটের কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা একই ছিল। তবে এ সময় কেন্দ্রগুলো থেকে সামিটের আয় বেড়েছে। গত অর্থবছর সামিটের কেন্দ্রগুলোর জন্য এক হাজার ৮৫৩ কোটি ৯২ লাখ টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয় পিডিবিকে। অর্থাৎ উৎপাদন সক্ষমতা থাকলেও গত অর্থবছর সামিটের ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ আয় বেড়েছে ৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ। আর সব মিলিয়ে ১০ বছরে সামিট ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ আয় করেছে সাত হাজার ৬৮৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্যাপাসিটি চার্জ বিদ্যুৎ খাতের জন্য বোঝাস্বরূপ। কোনো কারণে কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন বন্ধ থাকলেও এ অর্থ গুনতে হবে পিডিবিকে। এমনকি বর্তমানে চাহিদা না থাকায় বছরের বেশিরভাগ সময়ই বসে থাকছে বেসরকারি কেন্দ্রগুলো। এর পরও ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়মিতই পরিশোধ করতে হচ্ছে। তাই এ ধরনের লাইসেন্স প্রদানের আগে সংশ্লিষ্ট সব বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য ১৫ থেকে ২২ বছরের চুক্তিতে ক্যাপাসিটি চার্জ অনেক বেশি দেওয়া হয়েছে বলে মনে করেন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম। তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে সরকার দায়মুক্তি বিধান দিয়ে রেখেছে। ফলে এ খাতে কোনো প্রতিযোগিতা নেই, জবাবদিহিও নেই। আর এতে বেসরকারি খাত বাড়তি সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। আইনটির প্রয়োগ বন্ধ না হলে এ খাতে সুশাসনও ফিরবে না।

উল্লেখ্য, এসব কেন্দ্রের বাইরেও খুলনা পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (কেপিসিএল) ৩৫ শতাংশ শেয়ার রয়েছে সামিট গ্রুপের হাতে। ওই কোম্পানির অধীনে ৩টি কেন্দ্র থেকেও ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ আয় করে থাকে সামিট। তবে পৃথক কোম্পানি হওয়ায় এ প্রতিবেদনে তা অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।