Print Date & Time : 18 June 2025 Wednesday 2:39 am

এক বছরে খেলাপি ঋণ বাড়ল ১৭,৩৮৩ কোটি টাকা

রোহান রাজিব: দেশের ব্যাংক খাতে গত এক বছরে খেলাপি ঋণ ১৭ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা বেড়েছে। তবে খেলাপি ঋণের লাগাম টানতে ঋণ পরিশোধে বিশেষ ছাড় ও বছর শেষে ব্যাংকের ব্যালান্স শিট ভালো দেখাতে ঋণ আদায়ে জোর দেয়ার ফলে শেষ প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ কিছুটা কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, ডিসেম্বর-কেন্দ্রিক ব্যবসায়ীরা খেলাপি থাকতে চায় না। বছরের শেষ প্রান্তিকে ব্যাংকগুলো ব্যালান্স শিট ভালো দেখাতে খেলাপি ঋণ আদায়ে জোর দেয়। ফলে প্রতি বছরের শেষ প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ কমে যায়। এছাড়া কভিডকালে সময় ব্যাংকঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে দেয়া হয়েছিল বিশেষ ছাড় ও নানা সুবিধা। বছরের শুরুতে তা তুলে নেয়ার পর ধারাবাহিক বাড়তে থাকে। গত বছর ঋণের কিস্তির ৭৫ শতাংশ অর্থ জমা দিলে খেলাপি মুক্তির সুযোগ ছিল। কিন্তু তাতেও খেলাপি ঋণ না কমায় পরে খেলাপিদের সুবিধা আরও বাড়িয়ে দেয়া হয়। এ সুবিধার ফলে ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে যারা ঋণের কিস্তির ৫০ শতাংশ অর্থ জমা দিয়েছেন; তারা কেউ খেলাপি হননি। তারপরও বছরের ব্যবধানে বেড়েছে খেলাপি ঋণ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে ঋণস্থিতি ১৪ লাখ ৭৭ হাজার ৭৮৮ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে এক লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা; যা বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। অর্থাৎ উচ্চ খেলাপির ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের ব্যাংক খাত। কারণ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, খেলাপি ঋণের হার সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ সহনীয় বলে ধরা হয়।

২০২১ সালে ব্যাংক খাতে ঋণস্থিতি ছিল ১৩ লাখ এক হাজার ৭৯৭ কোটি ২৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে এক লাখ ৩ হাজার ২৭৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা; যা বিতরণ করা ঋণের ৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৭ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা। তবে তিন মাসের ব্যবধানে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ১৩ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা কমেছে। ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ব্যাংক খাতে এক লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা খেলাপি ছিল। ডিসেম্বর শেষে তা কমে এক লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, খেলাপি ঋণের যে চিত্র, এটা প্রকৃত চিত্র নয়। খেলাপি ঋণের সমস্যা দিন দিন প্রকট হচ্ছে। মূলত এটা একটা গাণিতিক হিসাব। শেষ প্রান্তিকে খেলাপি কমা মূলত ব্যালান্স শিট ভালো দেখানোর জন্য। এটা যদি সবসময় কমতে থাকে, তাহলে এ খাতের জন্যই ভালো।

২০১৮ থেকে ২০২২ সালÑ এ পাঁচ বছরে সবচেয়ে খেলাপি হয়েছে গত বছর। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সাল শেষে খেলাপির অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা; যা ২০২১ সালে ছিল ১ লাখ ৩ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা। একইভাবে ২০২০ সালে খেলাপির অঙ্ক ৮৮ হাজার ৭৩৪ কোটি, ২০১৯ সালে খেলাপি ৯৪ হাজার ৩৩১ কোটি এবং ২০১৮ সালে খেলাপি ছিল ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর শেয়ার বিজকে বলেন, ব্যাংকগুলো ঋণগ্রহীতাদের বছরের শেষ প্রান্তিকে চাপ দেয়। ব্যালান্স শিট ভালো দেখানোর জন্য তাদের ঋণ শোধ করতে বলে। ফলে ব্যবসায়ীরা কিছু টাকা দেয়। এতে শেষ প্রান্তিকে খেলাপি কিছুটা কমে। তবে খেলাপি ঋণ বাড়ার যে প্রবণতা, সেটা এখনও খারাপ পর্যায়ে আছে। কারণ বছর বছর খেলাপি ঋণ বেড়েই চলছে।

তিনি আরও বলেন, সরকারের খেলাপি ঋণ নিয়ে পরিষ্কার দিকনির্দেশনা দেখা যাচ্ছে না। সরকার ব্যবসায়ী মুডেই রয়েছে। ব্যাংক খাতের সম্প্রতি বড় ঘটনার কোনো প্রকার ব্যবস্থাও নেয়া হয়নি। ফলে এসব ঋণগুলো খেলাপি হবে। আগামী দিনে খেলাপি ঋণ আরও বেড়ে যাবে।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংক খাতের মোট খেলাপি ঋণের ৫৬ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকে। বেসরকারি ব্যাংকে ৫৬ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা, বিদেশি ব্যাংকে ৩ হাজার ৪৮ কোটি টাকা এবং বিশেষায়িত ব্যাংকে  ৪ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পরিমাণের দিক দিয়ে খেলাপি ঋণের শীর্ষ পাঁচ ব্যাংকের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকই চারটি। চার ব্যাংকের খেলাপি ৪৮ হাজার ৮০৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে অগ্রণী ব্যাংকের ১৪ হাজার ৮১০ কোটি, জনতার ১৪ হাজার ৩৮৭ কোটি, সোনালীর ১২ হাজার ৫ কোটি এবং বেসিক ব্যাংকের ৭ হাজার ৬০৪ কোটি টাকা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক শেয়ার বিজকে বলেন, ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ কমাতে অনেকদিন ধরে কাজ করছি। বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে ঋণ পরিশোধের ওপর চাপ তৈরি হয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে। গ্রাহকদের ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে নীতি সহায়তাও দেয়া হয়েছে। এসব নীতি সহায়তার কারণে খেলাপি ঋণ শেষ প্রান্তিকে কিছুটা কমেছে।