ইসমাইল আলী: গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দেয়া এবং আন্তর্জাতিক বাজারে ফার্নেস অয়েলের দাম ঊর্ধ্বমুখী থাকার প্রভাব পড়েছে বিদ্যুৎ খাতে। পাশাপাশি ডিজেলের দাম বৃদ্ধি ও কয়লা আমদানিতে শুল্কারোপের প্রভাবও রয়েছে। সব মিলিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। এতে রেকর্ড লোকসানের সম্মুখীন হয়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। এক বছরে সংস্থাটির লোকসান বেড়েছে ১৬৯ শতাংশ।
এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছর পিডিবির লোকসান বেড়েছিল সাড়ে ৫৪ শতাংশ। তবে গত অর্থবছর রেকর্ড ঘাটতি মেটাতে রেকর্ড পরিমাণ ভর্তুকি দাবি করে পিডিবি। যদিও ভর্তুকির পুরোটা ছাড় করেনি অর্থ মন্ত্রণালয়। চাহিদার অর্ধেকের বেশি ভর্তুকি বকেয়া রয়ে গেছে। আবার লোকসানের চাপ কমাতে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব দিলেও তা খারিজ করে দেয় বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। এতে জটিলতার মুখে পড়েছে পিডিবি।
সংস্থাটির তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থবছর পিডিবির লোকসান দাঁড়িয়েছে ৩১ হাজার আট কোটি ৩২ লাখ টাকা। আর ২০২০-২১ অর্থবছর সংস্থাটির লোকসানের পরিমাণ ছিল ১১ হাজার ৫০৯ কোটি ১২ লাখ টাকা। অর্থাৎ এক বছরে লোকসান বেড়েছে ১৯ হাজার ৪৯৯ কোটি ২০ লাখ টাকা বা ১৬৯ দশমিক
৪২ শতাংশ। যদিও গত অর্থবছর লোকসানের ঘাটতি পূরণে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে ভর্তুকি চাওয়া হয় ২৯ হাজার ৬৫৪ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। তবে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আট মাসে ছাড় করে ১৪ হাজার ৮৯০ কোটি টাকা। এখনো ১৪ হাজার ৭৬৪ কোটি ৪৩ লাখ টাকা ভর্তুকি বকেয়া রয়েছে।
এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছর পিডিবিকে ১১ হাজার ৭৭৭ কোটি ৯১ লাখ টাকা ভর্তুকি দিয়েছিল অর্থ মন্ত্রণালয়। তবে গত অর্থবছরের ভর্তুকির পুরোটা ছাড় করতে গিয়ে চলতি অর্থবছর শেষ হয়ে যেতে পারে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া চলতি অর্থবছর পিডিবির সম্ভাব্য লোকসান ৫১ হাজার ৮৫৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা দাঁড়াবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। আগামী অর্থবছর তা আরও বেড়ে ৬১ হাজার ৬৭২ কোটি ৪০ লাখ টাকা দাঁড়াবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
পিডিবির একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে বলেন, আগে পিডিবি বছরে যে পরিমাণ লোকসান গুনত, এখন এক মাসেই তার কাছাকাছি পরিমাণ লোকসান হচ্ছে। এর মূল কারণ বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরবরাহকৃত গ্যাসের পরিমাণ কমিয়ে দেয়া হয়েছে। এতে বাধ্য হয়ে তেলের কেন্দ্র বেশি চালাতে হচ্ছে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য অনেক বেড়েছে। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের প্রভাবে দাম আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। অথচ বিদ্যুতের বাল্ক মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব খারিজ করে দেয়ায় আয় বাড়ানো যাচ্ছে না।
তারা আরও বলেন, নতুন বেশ কয়েকটি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসছে। এতে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। এ কারণেও বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় বাড়বে। ভারতের আদানির বিদ্যুৎ কিনতেও অনেক বেশি ব্যয় হবে। তবে জাতীয় নির্বাচনের আগে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে চায় না সরকার। আবার অর্থ মন্ত্রণালয়ও চাহিদা অনুযায়ী ভর্তুকি ছাড় করছে না। সব মিলিয়ে আগামী দুই বছর বিদ্যুৎ খাতের জন্য খুবই কঠিন সময় অপেক্ষা করছে।
লোকসান বৃদ্ধির কারণ প্রসঙ্গে পিডিবির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. মাহবুবুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, গ্যাসের সরবরাহ কমায় তরল জ্বালানিভিত্তিক কেন্দ্রগুলোয় বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে হয়েছে। আর্ন্তজাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দামও অনেক বেড়েছে। আবার ফার্নেস অয়েল আমদানির শুল্ক-কর অব্যাহতি তুলে দেয়ায় ব্যয় বেড়েছে। কয়লা আমদানিতেও শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। ফলে লোকসান রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে।
প্রসঙ্গত, ২০১০-১১ অর্থবছর থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত ১২ বছরে এক লাখ ছয় হাজার ১৭৬ কোটি ২৭ লাখ টাকা লোকসান গুনেছে পিডিবি। এর মধ্যে ২০১০-১১ অর্থবছরে সংস্থাটির লোকসান ছিল চার হাজার ৬২০ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। ২০১১-১২ অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ছয় হাজার ৬৯৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। তবে ২০১২-১৩ অর্থবছর তা কিছুটা কমে দাঁড়ায় পাঁচ হাজার ৪৩ কোটি ৮৪ লাখ টাকা।
২০১৩-১৪ অর্থবছরে পিডিবির লোকসান আবার বেড়ে দাঁড়ায় ছয় হাজার ৮০৯ কোটি ২৫ লাখ টাকা এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সাত হাজার ২৮২ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছর তা কমে দাঁড়ায় তিন হাজার ৮৭৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বেড়ে হয় চার হাজার ৪৩৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে লোকসান আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৯ হাজার ৩১০ কোটি ১৫ লাখ টাকা।
পরের দুই অর্থবছর লোকসান কিছুটা কমে সংস্থাটির। এর মধ্যে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আট হাজার ১৪১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে সাত হাজার ৪৪৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকা লোকসান গুনে পিডিবি। তবে পরের দুই অর্থবছর তা ক্রমেই বেড়ে আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।