Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 5:48 am

এক বছরে বিদেশি ঋণ পরিশোধ বেড়েছে ৩১%

ইসমাইল আলী ও মাসুম বিল্লাহ: বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ বেড়েই চলেছে। এক বছরের ব্যবধানে এর পরিমাণ বেড়েছে রেকর্ড ১৪ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলার। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বিদেশি ঋণ পরিশোধ। এতে বিদেশি ঋণ পরিশোধ এক বছরে প্রায় পাঁচ বিলিয়ন ডলারে ঠেকেছে। সরকারি ও বেসরকারি খাত মিলিয়ে বিদেশি ঋণ পরিশোধ বেড়েছে ৩১ শতাংশের বেশি। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে এ চিত্র উঠে এসেছে।

তথ্যমতে, ২০২০-২১ অর্থবছর বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ছিল প্রায় তিন দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে সরকারি ঋণ শোধের পরিমাণ ছিল এক দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার ও বেসরকারি খাতে এক দশমিক ৮৪ বিলিয়ন ডলার। তবে ২০২১-২২ অর্থবছর বিদেশি ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে চার দশমিক ৯২ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে সরকারি ঋণ শোধ করা হয় দুই দশমিক শূন্য দুই বিলিয়ন ডলার ও বেসরকারি খাতে দুই দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার।

এ হিসাবে সরকারের বিদেশি ঋণ শোধের পরিমাণ বেড়েছে মাত্র শূন্য দশমিক ১১ শতাংশ। তবে বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণ পরিশোধ বেড়েছে ৫৭ দশমিক ৬১ শতাংশ। আর সার্বিকভাবে বিদেশি ঋণ পরিশোধ বেড়েছে ৩১ দশমিক ২০ শতাংশ। তবে ইআরডির বাইরেও রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন সংস্থা নিজস্বভাবে কিছু বিদেশি ঋণ নিয়ে থাকে। এছাড়া জ্বালানি তেল কেনার জন্য কিছু ঋণ নেয়া হয়। সেসব ঋণ পরিশোধ যোগ করলে বিদেশি ঋণ পরিশোধ আরও প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলার বাড়বে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত অর্থবছর বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণের পরিশোধের মধ্যে আসল ছিল দুই দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার। আর সুদ পরিশোধ করা হয় ১৮১ দশমিক ৫৯ মিলিয়ন ডলার ও কমিশন ৪২ দশমিক ৭২ মিলিয়ন ডলার। এদিকে সরকারের বিদেশি ঋণের পরিশোধের মধ্যে আসল ছিল এক দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলার এবং সুদ পরিশোধ করা হয় ৪৯০ দশমিক ৯৮ মিলিয়ন ডলার।

এদিকে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে সরকারের বিদেশি ঋণ পরিশোধ পাঁচ বিলিয়ন ডলারে ঠেকবে বলে প্রক্ষেপণ করেছে ইআরডি। সরকারের মধ্যম মেয়াদি ঋণ পরিচালনার কৌশলের (এমটিডিএস) অংশ হিসেবে গত মে থেকে জুন মাসের মধ্যে এই পূর্বাভাসটি তৈরি করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরে সুদাসল মিলিয়ে দুই দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে হবে বাংলাদেশকে।

প্রতিবছরই এর পরিমাণ বাড়বে। এর মধ্যে ২০২৩-২৪ অর্থবছর তিন দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার ও ২০২৪-২৫ অর্থবছর চার দশমিক শূন্য দুই বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হবে। আর ২০২৯-৩০ অর্থবছর ঋণ পরিশোধ দাঁড়াবে সর্বোচ্চ পাঁচ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার। এরপর ঋণ পরিশোধে চাপ কমতে থাকবে। ২০৩৪-৩৫ অর্থবছরে ঋণ পরিশোধের পরিমাণ দাঁড়াবে চার দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘২০২৬ সালের পর রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, কর্ণফুলী টানেল, পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পসহ বেশকিছু বড় ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হবে। ইআরডির হিসাব অনুযায়ী, ওই সময় থেকে মোট বিদেশি ঋণের বিপরীতে যে কিস্তি পরিশোধ করতে হবে, তাতে আসল বাবদই প্রায় পাঁচ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হবে। এর বাইরে বিভিন্ন ধরনের বায়ার্স ক্রেডিট, ডেফার্ড এলসি ও স্বল্পমেয়াদি ঋণ মিলে আরও কয়েক বিলিয়ন ডলার যুক্ত হবে। কাজেই এক ধরনের চাপ তো বাড়বেই। সেজন্য সরকারকে এখন থেকে কৌশল গ্রহণ করা উচিত।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত দুই বছরে বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি ঋণ দ্রুত বেড়েছে। ২০২০ সালের জুনশেষে বেসরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদি ঋণের পরিমাণ ছিল আট দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালের জুনশেষে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১১ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার। ২০২২ সালের জুনশেষে তা আরও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ দুই বছরে বেসরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদি ঋণ বেড়েছে ১০৩ শতাংশের বেশি। মূলত এর প্রভাবে ২০২১-২২ অর্থবছর বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণ পরিশোধ বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে।

উল্লেখ্য, ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৫ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে সরকারি ঋণের পরিমাণ ৬৯ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার এবং বেসরকারি ঋণ ২৫ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার। এর আগে (২০২০-২১) অর্থবছর দেশের মোট বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ৮১ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে সরকারি ঋণ ছিল ৬২ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন ডলার এবং বেসরকারি ঋণ ১৮ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার।

এ হিসাবে এক বছরে সরকারের বিদেশি ঋণ বেড়েছে সাত দশমিক শূন্য দুই বিলিয়ন ডলার ও বেসরকারি খাতের সাত দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ঋণ বেড়েছে পাঁচ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলার। স্বল্প সময়ের মধ্যে বিদেশি ঋণের এ উল্লম্ফন ভবিষ্যতে বিপদের কারণ হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। তারা বলছেন, দেশে এ মুহূর্তে ডলারের তীব্র সংকট চলছে। আগামীতে এ সংকট আরও গভীর হবে। এ অবস্থায় বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতকেও চাপে পড়তে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এ প্রসঙ্গে শেয়ার বিজকে বলেন, বেসরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদি ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আগে থেকেই কন্ট্রোল করা উচিত ছিল। ম্যাক্রো ইকোনমিক পলিসির ভুলের কারণে এখন ভুগতে হচ্ছে। এছাড়া এখন তো সুদের হারও বেড়ে গেছে। কারণ লাইবর (লন্ডন আন্তঃব্যাংক অফার রেট) বেড়ে গেছে। অর্থাৎ বেসরকারি খাতের ঋণ রিজার্ভের ওপর চাপ তৈরি করবে।

তিনি আরও বলেন, যদি এসব ঋণ পরিশোধ করতে না পারে, তাহলে বেসরকারি খাতের ঋণের ইমেজ নষ্ট হবে। আর এ টাকা তো শোধ দিতেই হবে। কারণ এটা রাষ্ট্রের জন্য একটা দায়বদ্ধতা (লায়াবিলিটি)। এটা থেকে এখন পরিত্রাণের উপায় নেই। তবে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।