ট্রেজারি বিল ও বন্ড বিক্রি

এক বছরে ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ ৪৬ হাজার কোটি টাকা

শেখ আবু তালেব: দ্রুত ও সহজসাধ্য হওয়ায় অর্থের চাহিদা মেটাতে সরকার ব্যাংকমুখী হয়। এজন্য প্রতিবছর জাতীয় বাজেট বাস্তবায়নে ঘাটতি মেটানোর উৎস হিসেবে ব্যাংক খাত থেকে ধার নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে রাখে সরকার। এতদিন সরাসরি ঋণ নেয়ার প্রবণতাই বেশি ছিল সরকারের। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ট্রেজারি বিল ও বন্ড ব্যবহার করে এক বছরে ঋণ নিয়েছে ৪৬ হাজার কোটি টাকার বেশি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে সরকারের ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ১৯ হাজার ৩৮৮ কোটি টাকা।

জানা গেছে, কভিডকালে সরকারি ও বেসরকারি খাতে ঋণ চাহিদা কম ছিল। এ সময় অতিরিক্ত তারল্য দুই থেকে তিন শতাংশ কাটঅফ রেটে সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ করেছে ব্যাংকগুলো। নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে এ খাতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন ব্যাংকাররা। আবার সরকারও দীর্ঘমেয়াদি উৎস হিসেবে ট্রেজারি বিল ও বন্ড ব্যবহার করে ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেয়ার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়।

তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ২৯ নভেম্বর থেকে চলতি বছর ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত সরকার এক বছরে নিট ৪৬ হাজার ২৩৮ কোটি টাকার ঋণ নেয়। ট্রেজারি বিল, বন্ড, স্পেশাল ট্রেজারি বন্ডস ও ইনভেস্টমেন্ট সুকুক ব্যবহার করে এ ঋণ নেয়া হয়। এ ঋণের প্রায় পুরোটাই ট্রেজারি বন্ডের মাধ্যমে নিয়েছে। এ খাত থেকে ৪৪ হাজার ৫৯৯ কোটি ঋণ নেয় সরকার। এছাড়া সুকুক থেকে সাত হাজার ৭৯৯ কোটি টাকা নেয় সরকার। আবার উত্তোলনকৃত অর্থ থেকে স্পেশাল ট্রেজারি বন্ডের বিপরীতে তিন হাজার ১৪৬ কোটি টাকা এবং ট্রেজারি বিলের বিপরীতে তিন হাজার ১৬ কোটি টাকা পরিশোধ করে।

সরকারের বিল ও বন্ড থেকে এত বেশি ঋণ নেয়ার বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘করোনা মহামারির ক্ষত কাটিয়ে উঠছে দেশের অর্থনীতি। এখনও রাজস্ব আদায়ের হার সেভাবে বাড়েনি। সরকারের দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহ ও বার্ষিক কর্মসূচি বাস্তবায়নে (এডিপি) অর্থের প্রয়োজন হচ্ছে। বিশেষ করে মেগাপ্রকল্পগুলোর কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এজন্য সরকার অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নিচ্ছে। ব্যাংক থেকে যেকোনো পদ্ধতিতেই সহজে ঋণ নেয়া যায় বলেই সরকার এদিকে যাচ্ছে। তবে খেয়াল রাখতে হবে যেন ব্যাংকগুলোয় তারল্যর সরবরাহে কোনো চাপ তৈরি না হয়।’

জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে (২০২১-২২) সরকারের ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা। কিন্তু চলতি অর্থবছরের গত নভেম্বর পর্যন্ত নতুন ঋণ নেয়া ও পুরোনোর সুদ-আসল পরিশোধ শেষে সরকারের নিট ঋণ নেয়ার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ২৭২ কোটি ৯৯ লাখ টাকা।

এই সময়ে সরকার ঋণ নেওয়ার পাশাপাশি পুরোনো ঋণের সুদ ও আসল কিছু পরিশোধ করেছে। ব্যাংকগুলোর সরকারে বিল ও বন্ডে বিনিয়োগে আগ্রহের বিষয়ে দেশের বেসরকারি খাতের পিডি ব্যাংকের এক ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, বেসরকারি খাতে ঋণ দিলে খেলাপি হওয়ার ঝুঁকি থাকে। আবার করোনাকালে ঋণচাহিদা কম ছিল, কিন্তু আমানতকারীদের ঠিকই সুদ দিতে হবে। এজন্য অপেক্ষাকৃত কম সুদ হলেও সরকারের বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ করেছে ব্যাংকগুলো। তখন এ খাত থেকে ইল্ড বা মুনাফার হার ছিল পাঁচ শতাংশে। এখন  তা সাড়ে সাত শতাংশে চলে এসেছে। ব্যাংকগুলো এ খাতে বিনিয়োগ করলে সোয়া আট শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা নিতে পারবে। এজন্য এখন ব্যাংকগুলো আরও আগ্রহী হয়ে উঠছে।

ট্রেজারি বিল ও বন্ডে অধিক বিনিয়োগের শঙ্কাও রয়েছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা মনে করছেন, বর্তমানে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের মুনাফার হার এ অবস্থায় চলতে থাকলে বেসরকারি খাতে ঋণ দিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে ব্যাংকগুলো। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, বর্তমানে সর্বোচ্চ ঋণ সুদহার হচ্ছে ৯ শতাংশ। এতে বিনিয়োগ ঝুঁকি রয়েছে। বিশেষ করে অর্থ আদায় ও খেলাপি হয়ে যাওয়ার বিষয়ে। কিন্তু সরকারি বিনিয়োগে কোনো ঝুঁকি নেই, নিরাপদ বিনিয়োগ। সমস্যা হচ্ছে শুধু দীর্ঘ মেয়াদে অর্থ দিতে হয়। ট্রেজারিতে বিনিয়োগ বাড়লে বেসরকারি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

বর্তমানে তারল্য দুই লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকা ছিল কয়েক মাস আগেও। সেখান থেকে নেমে এসেছে দুই লাখ ১৯ হাজার কোটি টাকায়। এ অর্থের বেশিরভাগই ট্রেজারি বিল ও বন্ডের নামে সরকারের কাছে রয়েছে ঋণ হিসেবে। উদ্বৃত্ত তারল্যের বেশিরভাগই সরকারের ট্রেজারি বিল ও বন্ডের আকারে গেছে। এতে এরই মধ্যে অনেক ব্যাংকেই নগদ অর্থের সংকট দেখা দিতে শুরু করেছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০