শেখ আবু তালেব : প্রতিনিয়ত ব্যাংক ব্যবস্থার বাইরে জনগণের হাতে নগদ টাকার পরিমাণ বেড়েই চলছে। গত এক বছরে নতুন করে আরও ১৮ হাজার কোটি টাকা চলে গিয়েছে ব্যাংক ব্যবস্থার বাইরে। এতে ব্যাংক খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধির হার কমে গেছে। আবার ঋণচাহিদা বাড়ায় ব্যাংকগুলো ভুগছে নগদ টাকার সংকটে। ফলে নগদ টাকার চাহিদা মেটাতে ওভারনাইট বা এক দিনের জন্য হলেও উচ্চ সুদে ধার করছে ব্যাংকগুলো।
এতে আন্তঃব্যাংক মুদ্রা ধারের প্ল্যাটফর্ম কলমানি মার্কেটে সুদের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নেয়া ধারের পরিমাণও বাড়ছে ক্রমাগত। অর্থের চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে স্পেশাল রেপোতেও ধারের আবেদন বাড়ছে। অর্থের চাহিদা মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও সাড়া দিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে এমন তথ্য।
এতে ব্যবসা বাড়ছে পর্যাপ্ত তারল্য থাকা বিদেশি ব্যাংকগুলোর। গত চার বছরের তথ্য পর্যবেক্ষণ করে ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরই) নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মানসুর বলেন, ‘বাংলাদেশে কার্ডে লেনদেন বাড়ছে। বিভিন্ন কেনাকাটা ও সার্ভিস চার্জ কার্ডের মাধ্যমে দেয়ার পরিমাণ আগের চেয়ে বেড়েছে। তার তেমন কোনো প্রভাব দেখা যাচ্ছে না অর্থনীতিতে। এখনও অর্থনীতি নগদ টাকানির্ভর। এর একটি দিক হচ্ছে কালোটাকার আকার বাড়ছে। দুর্নীতি ও অনিয়মের লেনদেনগুলো নগদে হয়। নগদ অর্থের সরবরাহ কমে যাওয়াটাই অর্থনীতির জন্য ভালো।’
ব্যাংক ব্যবস্থার নিয়ম অনুযায়ী, মুদ্রা তথা টাকা যত হাতবদলই হোক শেষ পর্যন্ত ব্যাংকের হিসাবের তালিকায় থাকে। শুধু হাতবদল তথা নিয়ন্ত্রণ বদলায়। কিন্তু দেশে প্রতিনিয়ত ব্যাংক ব্যবস্থার বাইরে জনগণের হাতে নগদ টাকার পরিমাণ বেড়েই চলছে। গত এক বছরে নতুন করে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা চলে গেছে ব্যাংক ব্যবস্থার বাইরে।
জানা গেছে, গত অক্টোবর শেষে ব্যাংক ব্যবস্থার বাইরে থাকা অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দুই লাখ পাঁচ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা, গত বছরের এই সময়ে যা ছিল এক লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকা। এ হিসাবে গত এক বছরে ব্যাংক ব্যবস্থার বাইরে নতুন করে আরও ১৭ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে অর্থ চলে যাওয়ার প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ।
জানা গেছে, ২০১৮ সালে মোট ব্যাংকিং নোটের বা এম-টু’র ১২ দশমিক ৩৫ শতাংশ ছিল ব্যাংক ব্যবস্থার বাইরে। পরের বছর ২০১৯ সালে তা দাঁড়ায় ১২ দশমিক ২৭ শতাংশে, ২০২০ সালে হয় ১৩ দশমিক শূন্য ছয় শতাংশ ও সর্বশেষ ২০২১ সালের অক্টোবরে দাঁড়ায় ১২ দশমিক ৯১ শতাংশে।
২০২০ সালে ব্যাংক খাতের বাইরে যাওয়া অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধির বিষয়ে আহসান এইচ মানসুর বলেন, ‘বছরটিতে করোনার প্রকোপ সবচেয়ে বেশি ছিল। এ সময়ে মানুষ অর্থ নিজের কাছে রেখেছে। সে হিসাবে একটু বাড়বে। কিন্তু গত চার বছরের তুলনা করলে দেখা যায় ব্যাংক ব্যবস্থার বাইরে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছেই। করোনা-পূর্ববর্তী তথ্যের সঙ্গে এখনকার তথ্য তাই বলছে।’
এদিকে করোনার প্রভাব কমে আসা ও অর্থনীতির চাকা স্বাভাবিক হতে শুরু করায় বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ এখন দুই অঙ্কের ঘরে। সর্বশেষ প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত নভেম্বর শেষে বেসরকারি বা ব্যক্তি খাতের ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। এর আগের মাস অক্টোবরে যা ছিল ৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ। দীর্ঘদিন পরে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি দুই অঙ্কের ঘরে পৌঁছাল।
বর্ধিত ঋণচাহিদা মেটাতে ব্যাংকগুলোতে তারল্যপ্রবাহ কমে যাচ্ছে। গত পাঁচ মাসে ব্যাংকে তারল্যের পরিমাণ কমেছে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। গত বছরের জুলাই মাসে মুদ্রানীতি ঘোষণার পর ব্যাংক খাতের উদ্বৃত্ত তারল্য ছিল দুই লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকা। গত নভেম্বরে তা কমে দাঁড়ায় দুই লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ এই পাঁচ মাসে উদ্বৃত্ত তারল্য কমেছে পাঁচ দশমিক ৮৭ শতাংশ।
নগদ অর্থের চাহিদা মেটাতে অন্য ব্যাংকের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ছুটছে ব্যাংকগুলো। এতে কলমানি সুদ হার বেড়েছে সাম্প্রতিক সময়ে। কয়েক দিনের জন্য অর্থ চেয়েও পাচ্ছে না অনেক ব্যাংক। ফলে বাধ্য হয়ে দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে এক দিনের জন্য হলেও অর্থ ধারের দিকে ছুটছে ব্যাংকগুলো। এতে ওভারনাইট বা এক দিনের জন্য ধার করা অর্থের বিপরীতে সুদহার বেড়েছে অস্বাভাবিকহারে।
তথ্য বলছে, গত ৬ জানুয়ারি ওভারনাইট সুদহার সর্বোচ্চ পাঁচ দশমিক ২৫ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে। দিনটিতে ১১৯টি লেনদেন করে বিভিন্ন ব্যাংক। এই সময়ে গড় এ খাতে গড় সুদহার ছিল দুই দশমিক ৬২ শতাংশ। এছাড়া চার দিনের জন্য নেওয়া অর্থের সুদহার ছিল সর্বোচ্চ দুই দশমিক ৮৫ শতাংশ। গড় সুদহার ছিল দুই দশমিক ৩০ শতাংশ।
এছাড়া ৫, ৬, ৭, ১০, ১৪ ও ৯০ দিনের জন্য নেয়া অর্থের বিপরীতেও সুদহার তুলনামূলক বেড়েছে। এতে কলমানি মার্কেটে গড় সুদহার দাঁড়িয়েছে এক থেকে দুই দশমিক ৩৫ শতাংশ। বছরের দ্বিতীয় দিনে এটি গড়ে উঠেছিল চার শতাংশ পর্যন্ত।
উল্লেখ্য, বর্তমানে দেশের ব্যাংক খাতে আমানতের পরিমাণ হচ্ছে গত অক্টোবর শেষে ১৩ লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকা। প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ১০ দশমিক ৯৫ শতাংশ। অপরদিকে ঋণের পরিমাণ হচ্ছে ১৫ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। এ খাতে প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ১১ শতাংশ।