Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 2:50 pm

এক বছরে রিজার্ভ কমেছে ১০ বিলিয়ন ডলার

রোহান রাজিব: আমদানির দায় মেটাতে গত এক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে চলছে বাংলাদেশ ব্যাংক। রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বাড়লেও এ সময় ডলারের চাহিদা মিটছে না। তাই চাহিদা মেটাতে গত ১৫ মাসে ১১ বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে বিক্রি করে। ফলে গত এক বছর রিজার্ভ কমে দাঁড়িয়েছে ৩৬ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলারে। এ সময় ডলারের দাম বেড়েছে প্রায় ১৯ টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ধারাবাহিকভাবে রিজার্ভ কমে যাওয়া উদ্বেগজনক। কমার পেছনে অন্যতম কারণ রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে কিছু ব্যাংক চাহিদা মেটাচ্ছে। এটা এখনই বন্ধ করতে হবে। তা না হলে ভবিষ্যতে রিজার্ভ নিয়ে শঙ্কা দেখা দেবে। বাংলাদেশ ব্যাংক যেসব ব্যাংকে রিজার্ভ থেকে সাপোর্ট দিচ্ছে, তাদের উচিত অন্য ব্যাংকের মতো বাজার থেকে ডলার সংগ্রহ করে আমদানি দায় মেটানো।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৪৬ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার। ২০২২ সালের একই সময় এ রিজার্ভের পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ৩৬ বিলিয়ন ৪৪ ডলারে। অর্থাৎ গত এক বছরের ব্যবধানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেছে ৯ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন ডলার। চলতি বছরের জুন শেষে ছিল ৪১ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার। আগস্ট শেষে কমে দাঁড়ায় ৩৯ বিলিয়ন ডলারে।

সাধারণভাবে একটি দেশে ছয় মাসের আমদানি দায় মেটানোর মতো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকাকে নিরাপদ মনে করা হয়। গত অর্থবছর আমদানিতে বাংলাদেশের ব্যয় হয়েছে ৮২ দশমিক ৫০ বিলিয়ন বা ৮ হাজার ২৫০ কোটি ডলার। প্রতি মাসে গড়ে ৬৮৭ কোটি ডলার ব্যয় ধরলে বাংলাদেশের বর্তমান রিজার্ভ দিয়ে পাঁচ মাসের সামান্য বেশি সময় আমদানি দায় মেটানো সম্ভব।

তবে বর্তমানে ৩৬ বিলিয়ন ডলারের যে রিজার্ভ রয়েছে তার পুরোটা ব্যবহারযোগ্য না। ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ রয়েছে ২৯ বিলিয়ন ডলার। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক যে হিসাব প্রকাশ করে, তাতে ইডিএফসহ বিভিন্ন তহবিলে জোগান দেয়া অর্থও রিজার্ভ হিসেবে দেখানো হয়। আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে দেখানো রিজার্ভ থেকে সাত বিলিয়ন ডলার বাদ যাবে। এতে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ থাকে ২৯ বিলিয়ন ডলার। এ রিজার্ভ দিয়ে চার মাসের আমদানি দায় মেটানো যাবে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, ধারাবাহিক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করলে এটা ফুরাতে বেশি সময় লাগবে না। এখনই সতর্ক হতে হবে। তা না হলে এক বছরের

মধ্যে সংকট দেখা দেবে। সংকট কেটে যাবে এমন আত্মতুষ্টির মধ্যে থাকা যাবে না।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এখন শুধু রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করছে। এতে এসব ব্যাংক ৯৬ টাকায় ডলার কেনার সুযোগের ফলে হয়তো সরকারের গম ও সার আমদানিতে এক ধরনের প্রণোদনা হিসেবে কাজ করছে। তবে বিক্রি না করলে এসব ব্যাংক বাজার থেকে কিনবে। কেননা অন্য ব্যাংকগুলো কোনো না কোনোভাবে তো চলছে।

তিনি আরও বলেন, বাণিজ্য ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে না আসলে রিজার্ভ কমতে থাকবে। এটা সামাল দিতে হলেÑপ্রথমত, অন্যান্য সোর্স থেকে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করতে হবে। তাহলে রিজার্ভ থেকে বাণিজ্য ঘাটতির অর্থায়ন করা লাগে না। দ্বিতীয়ত, মুদ্রা বিনিময় হারকে নমনীয় করতে হবে।

ডলার সংকটের কারণে প্রতিনিয়ত রিজার্ভ কমছে। দেশে যে পরিমাণ ডলার দরকার সে পরিমাণ জোগান হচ্ছে না। ফলে গত এপ্রিলে দেশে যে পরিমাণ রপ্তানি ও প্রবাসী আয় হয়, আমদানি খরচ হয় তার চেয়ে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার বেশি। তাই আমদানির দায় মেটাতে রিজার্ভ থেকে ডলার ছাড় করতে হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের দাম আটকে রেখে সংকট আরও গভীর করে তুলে।

এমন পরিস্থিতিতে টাকার অবমূল্যায়ন করে ধীরে ধীরে ডলারের দাম বাড়ানো শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত এক বছরে ডলারের দাম বেড়েছে প্রায় ১৯ টাকা। গত বছরের সেপ্টেম্বরে এক ডলারপ্রতি খরচ হতো ৮৫ টাকা ৩৫ পয়সা। বর্তমানে এক ডলারে খরচ হচ্ছে ১০৩ টাকা।

তবে ডলার সংকট কাটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক নানা পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। আমদানি কমাতে কিছু পণ্যের ওপর ঋণ বন্ধ করে দেয়া হয়। কিছু পণ্য আমদানিতে শতভাগ মার্জিন দেয়া হয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডও কিছু পণ্য আমদানিতে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে। ফলে ঋণপত্র খোলা কমে গেছে। তবে ডলারের সংকট এখনও কাটেনি।

নানা পদক্ষেপের পরও চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ৫৮৬ কোটি ডলার আমদানি হয়েছে। আগের বছরের একই মাসের তুলনায় যা ২৩ দশমিক ২০ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছর প্রায় ৩৬ শতাংশ বেড়ে ৮ হাজার ২৫০ কোটি ডলার আমদানি হয়। তবে গত অর্থবছর রেমিট্যান্স ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ কমে ২ হাজার ১০৩ কোটি ডলারে নামে। অবশ্য চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে রেমিট্যান্স ১২ দশমিক ২৯ শতাংশ বেড়ে ৪১৩ কোটি ডলার হয়েছে। এ সময় রপ্তানি আয় ২৫ দশমিক ৩১ শতাংশ বেড়ে ৮৫৯ কোটি ডলার হয়েছে।

ডলার সংকট কাটাতে গত ২৬ মে বাংলাদেশ ব্যাংক বৈঠক করে এক্সচেঞ্জ অথরাইজড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এবিবির সঙ্গে। ওই বৈঠকে নির্দিষ্ট একটি ‘সিলিংয়ের’ মধ্যে আন্তঃব্যাংকে লেনদেনে ডলারের একক দর নির্ধারণের সিদ্ধান্তে সম্মতি দেয় বাফেদা।

বাংলাদেশ ব্যাংক এর আগে আন্তঃব্যাংক লেনদেনে ডলারের দর নির্ধারণের বিষয়টি বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। নিয়মিত টাকার মান কমানোর পাশাপাশি চাহিদা মেটাতে বড় অঙ্কের ডলারও বিক্রি করে আসছিল। তখনই আলোচনা শুরু হয়েছিল, একক দর নির্ধারণ করবে বাফেদা। ব্যাংকগুলো নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ডলারের বিনিময় হার কেমন হবে সেটির প্রস্তাব দেবে। বাংলাদেশ ব্যাংক সেই দর বাস্তবায়নে তদারকি করবে।

ওই বৈঠকের পর মে মাসের শেষ সপ্তাহে বাফেদা একটি প্রস্তাবও জমা দেয়। সে অনুযায়ী কিছু সিদ্ধান্ত এলেও পরের কার্যক্রম ঝিমিয়ে পড়ে। এর মধ্যে ডলারের সংকট আরও বাড়লেও এবং আন্তঃব্যাংকে কোনো নির্দিষ্ট দর না থাকায় বাড়তি মুনাফা করতে কিছু ব্যাংক ডলার লেনদেন একেবারে কমিয়ে দেয়। এতে আন্তঃব্যাংক লেনদেন অনেকটা স্থবির হয়ে পড়ছে।

এ সময় ব্যাংকে নগদ ডলারের দর ওঠে ১০৭ টাকা, আর খোলাবাজারে একপর্যায়ে তা রেকর্ড ১২১ টাকায় ওঠে। এমন প্রেক্ষাপটে বাফেদার কার্যক্রমে গতি না আসায় আবার সংগঠনটির সঙ্গে বৈঠকে বসেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। গত ১৪ আগস্টের বৈঠকে ব্যাংকের নগদ ডলার কেনা ও বেচার ব্যবধান সর্বোচ্চ এক টাকা করার সিদ্ধান্ত হয়।

বৈঠকে আন্তঃব্যাংক লেনদেন বাজার সক্রিয় করতে আবার সংগঠনটি প্রস্তাব দেবে বলে জানায়। এরপর ৮ সেপ্টেম্বর এবিবি ও বাফেদার প্রতিনিধিরা বাংলাদেশ ব্যাংকে গিয়ে আবার বৈঠক করেন। সে দিন সিদ্ধান্ত হয় ডলারের দাম নির্ধারিত হবে চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে। ব্যাংকগুলো নিজেই এই দাম নির্ধারণ করবে। প্রবাসী ও রপ্তানি আয়, আমদানি বিল নিষ্পত্তিসহ প্রতিটি লেনদেনে ডলারের দাম হবে পৃথক। তবে সব ব্যাংক প্রতি লেনদেনেই একই দামে ডলার কেনাবেচা করবে। কেনাবেচায় মুনাফা হবে সর্বোচ্চ এক টাকা। সে দিনের সিদ্ধান্তের ফলে গত ১১ সেপ্টেম্বর ব্যাংকারদের সভায় এক্সপোর্ট প্রসিডে ৯৯ টাকা ও রেমিট্যান্সের ডলার ১০৮ টাকায় কেনার সিদ্ধান্ত হয়। এরপর বাজার পর্যালোচনা করে গত ২৬ সেপ্টেম্বর অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বাফেদা রপ্তানিতে ডলারের দাম ৯৯ টাকা ও প্রবাসী আয় ১০৭ টাকা ৫০ পয়সা নির্ধারণ করে।