নিয়াজ মাহমুদ : দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) ২০০৫ সালে প্রথম তালিকাভুক্ত হয় সরকারি ট্রেজারি বন্ড। শুধু তালিকাভুক্তির দিনই হয় বন্ডের উদ্বোধনী লেনদেন। এরপর প্রায় এক যুগেও বন্ডের আর কোনো লেনদেন হয়নি। যদিও ডিএসইর মোট বাজার মূলধনের প্রায় ১৭ শতাংশই হচ্ছে বন্ড। এ অবস্থায় ট্রেজারি বন্ডকে সচল করতে বাংলাদেশ ব্যাংক, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি ও ডিএসইর সমন্বয়ে একটি ‘কোঅর্ডিনেশন কমিটি’ গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়। এছাড়া গত ২৮ মার্চ বিএসইসিতে লিখিতকারে একটি প্রস্তাবনা জমা দিয়েছে ডিএসই। এ বছরের মধ্যে সরকারি ট্রেজারি বন্ডগুলো লেনদেন শুরু করতে তিন পক্ষই একমত বলে জানা গেছে। ডিএসইর প্রস্তাবনায় বন্ড মার্কেটকে গতিশীল করতে ডিএসই কর্তৃপক্ষ পুরোপুরি প্রস্তুত বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, পাঁচ কারণে বন্ডের লেনদেন হচ্ছে না। দেশে বন্ড মার্কেট জনপ্রিয় করতে তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। মুনাফা কম পক্ষান্তরে বন্ডের চেয়ে সঞ্চয়পত্রে মুনাফা বেশি। বর্তমান বন্ডের লেনদেন সিডিবিএলের অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায় ডিলাররা (এডি) এসব বন্ডের লেনদেনের জন্য প্রস্তাব করছে না। বন্ড লেনদেনে ব্রোকার হাউজের কমিশন কম হওয়ায় ট্রেজারি বন্ডের লেনদেন দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ। এছাড়াও নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক, বিএসইসি ও স্টক এক্সচেঞ্জের মধ্যে সমন্বয়ের ঘাটতির কারণেও বন্ড বাজার চাঙ্গা হচ্ছে না বলে মনে করছেন তারা।
বন্ড মার্কেটকে গতিশীল করার জন্য কার্যকর উদ্যোগ নিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে এগিয়ে আসতে হবে বলে মনে করেন পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ। তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, ‘পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতার জন্য বন্ডের শক্তিশালী অবস্থান জরুরি। বিশ্বের অন্যান্য স্টক এক্সচেঞ্জে বন্ড বাজার বেশ শক্তিশালী। কিন্তু আমাদের দেশে সেটা হচ্ছে না। এজন্য উদ্যোগ নিতে হবে। একইসঙ্গে বিনিয়োগকারীদের বন্ড সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে।’
বন্ড মার্কেটের করুণ দশার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক, বিএসইসির দায়িত্বহীন আচরণই দায়ী বলে মনে করেন ডিএসইর পরিচালক শাকিল রিজভী। তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, বিশ্ব পুঁজিবাজারে ইকুইটির মার্কেটের চেয়ে গতিশীল বন্ড মার্কেট। কিন্তু আমাদের দেশের বন্ডগুলোয় বিনিয়োগকারীদের সহায়ক না হওয়ায় বিনিয়োগকারীরাও এর প্রতি আকৃষ্ট হয় না।
শীর্ষস্থানীয় এক মার্চেন্ট ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী বলেন, স্বল্প সুদ এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ না থাকায় পুঁজিবাজারে বন্ডে লেনদেন হচ্ছে না। এছাড়া বন্ডের প্রতি ইউনিটের মূল্য বেশি হওয়া, কম মুনাফা ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের তেমন ধারণা না থাকায় সচল হচ্ছে না বন্ড মার্কেট।
এ প্রসঙ্গে ডিএসইর চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবুল হাশেম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘উন্নত দেশগুলোয় সব ধরনের বন্ড মার্কেট বেশ শক্তিশালী। কিন্তু আমাদের বন্ড মার্কেটে কোনো লেনদেনই হয় না। আমরা ইতোমধ্যে উদ্যোগ নিয়েছি শেয়ার মার্কেটের ন্যায় বন্ড মার্কেটও শক্তিশালী করার। এজন্য দায়িত্ব নেওয়ার পরই গত ৭ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে বৈঠক করি। যেখানে ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নররা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষিত সরকারি ট্রেজারি বন্ড লেনদেনের বিষয়ে বাস্তবসম্মত আলোচনা হয়।’
বিএসইসিতে পাঠানো প্রস্তাবনার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বন্ড মার্কেট সক্রিয় করতে কী কী প্রতিবন্ধকতা আছে, সেগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা পলিসিগত সহায়তা দেওয়ার আশ্বাসও দিয়েছে। এ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসির অব্যাহত সমর্থনসাপেক্ষে সরকারি ট্রেজারি বন্ডের লেনদেন আবারও শুরু হবে বলে আশা করছি।’
ডিএসইর প্রস্তাবনায় ‘২২১টি বন্ডের মধ্যে সবগুলোরই অভিহিত মূল্য এক লাখ টাকা’ উল্লেখ করে এগুলোর অভিহিত মূল্য ১০ হাজার টাকায় নামিয়ে আনার সুপারিশ করা হয়।
বিএসইসি সূত্রে জানা গেছে, বন্ড মার্কেটকে শক্তিশালী করতে কমিশনও সক্রিয়। ডিএসইর প্রস্তাবনা ও বিএসইসির নিজস্ব চিন্তাভাবনা নিয়ে শিগগিরই একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে একটি কোঅর্ডিনেশন কমিটি গঠিত হবে বলে জানান বিএসইসির একাধিক কর্মকর্তা।
উল্লেখ্য, ট্রেজারি বন্ডের ডিপোজিটরি হিসাব সিডিবিএলের পরিবর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের মার্কেট ইনফ্রাস্ট্রাকচার (এমআই) মডিউলে সংরক্ষণ করা হয়। পুঁজিবাজারে ৫, ১০, ১৫ এবং ২০ বছর মেয়াদি ২২১টি বন্ড তালিকাভুক্ত হয়েছে। এগুলোর বর্তমান পরিশোধিত মূলধন ৫৬ হাজার কোটি টাকা; যা ডিএসইর মোট বাজার মূলধনের প্রায় ১৭ শতাংশ।
এর আগে বন্ডের লেনদেন অন্যান্য কোম্পানির মতো করতে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসিকে চিঠি দেয় ডিএসই। বছর পার হলেও সে চিঠির কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। যেসব প্রতিবন্ধকতার কারণে ট্রেজারি বন্ডের লেনদেন বন্ধ, সে বিষয়গুলোও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।