Print Date & Time : 25 June 2025 Wednesday 10:45 am

এক শতাংশের কম মুনাফা ২০ কোম্পানির শেয়ারে

গতিশীল পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বাড়ছে। এর মধ্যে উচ্চ মুনাফা বা লভ্যাংশের ঘোষণায় লাফিয়ে বাড়ছে বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারদর। তবে এসব শেয়ারের প্রকৃত মুনাফার বিষয়ে খোঁজ নিচ্ছেন না অনেকেই। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। তাই বিভিন্ন কোম্পানির ২০১৬-১৭ হিসাববছরের প্রকৃত মুনাফাচিত্র তুলে ধরতে শেয়ার বিজের ধারাবাহিক আয়োজন। আজ ছাপা হচ্ছে শেষ পর্ব

নাজমুল ইসলাম ফারুক: তিন দশকের মধ্যে গত বছর সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে যায় ব্যাংক আমানতের সুদহার। এ হার এতই কম যে, তা ছিল মূল্যস্ফীতির হারেরও নিচে। এজন্য বিকল্প উৎস হিসেবে অনেক আমানতধারী পুঁজিবাজারমুখী হয়েছেন। বাজার হয়ে ওঠে গতিশীল। তবে কোন কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করবেন, তা নিয়ে অনেকেই রয়েছেন দ্বিধায়। কারণ তালিকাভুক্ত বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ারপ্রতি প্রকৃত মুনাফার হার (ইল্ড) ব্যাংক সুদহারের চেয়েও কম। এর মধ্যে ২০ কোম্পানির ইল্ড এক শতাংশের নিচে রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শেয়ারমূল্য বেশি হওয়া বা নামমাত্র লভ্যাংশ দেওয়ায় এসব কোম্পানির ইল্ড এক শতাংশের নিচে রয়েছে। তবে ভবিষ্যতে ভালো লভ্যাংশ দিলে বা শেয়ারদর নেমে গেছে এর উল্টোচিত্রও দেখা যেতে পারে। তাছাড়া যেসব কোম্পানির পারফরম্যান্স দুর্বল সেগুলোর মুনাফাও তুলনামূলক অনেক কম।

ইয়াহু ফাইন্যান্সের ভাষ্যমতে, কোনো কোম্পানি বিনিয়োগকারীদের আয়ের যে অংশ দেয়, তা হলো লভ্যাংশ। এটি সাধারণত শেয়ারপ্রতি আয় প্রকাশ করে। তবে বিভিন্ন কোম্পানির লভ্যাংশের হারের মধ্যে তুলনায় ব্যবহার করা হয় ইল্ড বা প্রকৃত মুনাফা। এক্ষেত্রে লভ্যাংশকে শেয়ারমূল্য দিয়ে ভাগ করে প্রকৃত মুনাফা নির্ণয় করা হয়। শেয়ারমূল্য বেশি হলে আর লভ্যাংশ কম দেওয়া হলে ইল্ড নিম্নমুখী হয়।

ইল্ডের গ্রহণযোগ্য কোনো হার না থাকলেও বাজারের অন্যান্য কোম্পানির সঙ্গে তুলনাকে গুরুত্ব দিচ্ছে ইয়াহু বিজনেস। তবে মূল্যস্ফীতি ও ব্যাংক সুদহারের চেয়ে ইল্ড বেশি হওয়া উচিত বলেই মত সংস্থাটির।

সূত্রমতে, ন্যূনতম ইল্ডের মধ্যে প্রকৌশল খাতের কোম্পানি রয়েছে পাঁচটি, বস্ত্র খাতের চারটি, ওষুধ ও রসায়ন খাতের চারটি, জ্বালানি খাতের তিনটি, পাট খাতের দুটি, খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতের একটি এবং বিমা খাতের একটি কোম্পানি। কম মুনাফা হওয়া কোম্পানিগুলো হলোÑবিএসআরএম লিমিটেড, ইস্টার্ন কেব্লস, মুন্নু স্টাফলার্স, রেইনউইক যজ্ঞেশ্বর, ন্যাশনাল টি কোম্পানি, সিভিও পেট্রোকেমিক্যাল, ডরিন পাওয়ার, ইস্টার্ন লুব্রিক্যান্ট, প্রগতি লাইফ ইন্স্যুরেন্স, নর্দার্ন জুট, সোনালী আঁশ, এমবি ফার্মা, কোহিনুর কেমিক্যাল, লিবরা ইনফিউশন, ওয়াটা কেমিক্যাল, আল-হাজ টেক্সটাইল, মডার্ন ডায়িং, সিমটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ, স্টাইলক্রাফট।

এ সম্পর্কে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, কোম্পানির পারফরম্যান্সের ওপর নির্ভর করে মুনাফা ওঠানামা করে। যেসব কোম্পানি ভালো লভ্যাংশ দিয়েছে ও শেয়ারদর কিছুটা কম, তাদের প্রকৃত মুনাফা বেশি। সেই সঙ্গে যাদের পারফরম্যান্স দুর্বল তাদের প্রকৃত মুনাফা কম। তবে ভবিষ্যতে বেশি লভ্যাংশ দিলে এসব কোম্পানির প্রকৃত মুনাফা বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, শেয়ারে বিনিয়োগের মাধ্যমে দুই ধরনের গেইন হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রত্যাশা হলো ডিভিডেন্ড গেইন। কারণ সব বিনিয়োগকারীর পক্ষে ক্যাপিটাল গেইন সম্ভব হয়ে উঠে না। তাই ডিভিডেন্ড গেইন করতে পারলে ভালো মুনাফা পাওয়া যায়। কিন্তু যেসব কোম্পানি নামমাত্র ডিভিডেন্ড দেয় তাদের কারণে গেইন সবচেয়ে দুর্বল হয়। অর্থাৎ কোনো রকম গেইন হয়। তাদের প্রকৃত মুনাফা আমানতের সুদের হারের চেয়ে অনেক কম।

লংকাবাংলা সিকিউরিটিজ হাউজে ট্রেড করে আনিসুজ্জামান। তিনি বলেন, আমি যখন প্রথম দিকে শেয়ারে বিনিয়োগ করি তখন লভ্যাংশ পাওয়ার আশায় কোম্পানিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতাম। কিন্তু যখন দেখলাম লভ্যাংশ পাচ্ছি কিন্তু বছর শেষে তার প্রকৃত মুনাফা খুবই সামান্য, তখন থেকে তার আশা ছেড়ে দিয়েছি। কারণ প্রত্যাশা অনুযায়ী প্রাপ্তি হয় না। তাই লভ্যাংশ গেইনের চেয়ে ক্যাপিটাল গেইন করার চেষ্টা করি। কিন্তু বেশিরভাগ সাধারণ বিনিয়োগকারী এটা  বোঝে না। অনেকেই লভ্যাংশের দিকে তাকিয়ে থাকে, অবশেষে ন্যূনতম মুনাফা পায়, যা প্রাপ্তির মাধ্যমে বিনিয়োগের মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হয়।

তথ্যমতে, কোম্পানিগুলোর মধ্যে বিএসআরএম সর্বশেষ শেয়ারহোল্ডারদের ২০ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছে। এর মধ্যে ১০ শতাংশ নগদ এবং ১০ শতাংশ বোনাস। লভ্যাংশের প্রকৃত মুনাফা দাঁড়িয়েছে শূন্য দশমিক ৭৪ শতাংশ। ইস্টার্ন  কেব্লস লিমিটেড শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ১০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে। এর প্রকৃত মুনাফা হয়েছে শূন্য দশমিক ৭৪ শতাংশ। মুন্নু স্টাফলার্স শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ১০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে। এর প্রকৃত মুনাফা দাঁড়িয়েছে শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ।

রেইনউইক যজ্ঞেশ্বর শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ১২ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছে। এর প্রকৃত মুনাফা দাঁড়িয়েছে শূন্য দশমিক ২০ শতাংশ। ন্যাশনাল টি কোম্পানি সর্বশেষ ৩০ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছে। এর প্রকৃত মুনাফা দাঁড়িয়েছে শূন্য দশমিক ৫৯ শতাংশ। সিভিও পেট্রোকেমিক্যাল শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ২৫ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছে। এর প্রকৃত মুনাফা দাঁড়িয়েছে শূন্য দশমিক ৯৭ শতাংশ। ডরিন পাওয়ার সর্বশেষ ২০ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছে। এর মধ্যে ১০ শতাংশ নগদ এবং ১০ শতাংশ বোনাস। এর প্রকৃত মুনাফা দাঁড়িয়েছে শূন্য দশমিক ৬৭ শতাংশ।

এদিকে ইস্টার্ন লুব্রিক্যান্ট শেয়ারহোল্ডারদের ১০০ শতাংশ লভ্যাংশ দিলেও প্রকৃত মুনাফা দাঁড়িয়েছে মাত্র শূন্য দশমিক ৮৬ শতাংশ। প্রগতি লাইফ ইন্স্যুরেন্স শেয়ারহোল্ডারদের সর্বশেষ ২৫ শতাংশ লভ্যাংশ দিলেও প্রকৃত মুনাফা হয়েছে শূন্য দশমিক ৭৯ শতাংশ। নর্দার্ন জুট শেয়ারহোল্ডারদের ৪০ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছে। এর মধ্যে ২০ শতাংশ নগদ এবং ২০ শতাংশ বোনাস। এর প্রকৃত মুনাফা হয়েছে শূন্য দশমিক ৪৩ শতাংশ।

সোনালী আঁশ লিমিটেড শেয়ারহোল্ডারদের ১০ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছে। এর প্রকৃত মুনাফা দাঁড়িয়েছে শূন্য দশমিক ৮১ শতাংশ। এমবি ফার্মা শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ২৬ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে। এর প্রকৃত মুনাফা দাঁড়িয়েছে শূন্য দশমিক ৯০ শতাংশ। কোহিনুর কেমিক্যাল শেয়ারহোল্ডারদের জন্য মোট ৩০ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছে। এর মধ্যে ১৫ শতাংশ নগদ ও ১৫ শতাংশ বোনাস। এর প্রকৃত মুনাফা হয়েছে শূন্য দশমিক ৩৬ শতাংশ। লিবরা ইনফিউশন শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ৩০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে। এর প্রকৃত মুনাফা হয়েছে শূন্য দশমিক ৫৭ শতাংশ। ওয়াটা কেমিক্যাল শেয়ারহোল্ডারদের জন্য শূন্য দশমিক ১৫ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছে। এর মধ্যে ১০ শতাংশ নগদ ও পাঁচ শতাংশ বোনাস। এর প্রকৃত মুনাফা দাঁড়িয়েছে শূন্য দশমিক ৬২ শতাংশ। আল-হাজ টেক্সটাইল ১৫ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছে। এর মধ্যে পাঁচ শতাংশ নগদ ও ১০ শতাংশ বোনাস। এর প্রকৃত মুনাফা দাঁড়িয়েছে শূন্য দশমিক ৫৯ শতাংশ।

মডার্ন ডায়িং শেয়ারহোল্ডারদের জন্য আট শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছে। এর প্রকৃত মুনাফা দাঁড়িয়েছে শূন্য দশমিক ৩৩ শতাংশ। সিমটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ১২ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছে। এর মধ্যে দুই শতাংশ নগদ এবং ১০ শতাংশ বোনাস। এর প্রকৃত লভ্যাংশ দাঁড়িয়েছে শূন্য দশমিক ৭১ শতাংশ। স্টাইলক্রাফট শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ৯০ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছে। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ বোনাস এবং ১০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ। এর প্রকৃত মুনাফা হয়েছে মাত্র শূন্য দশমিক শূন্য আট শতাংশ।