এখনও রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুতের ফাঁদে বাংলাদেশ!

ইসমাইল আলী: ২০০৯ সালের ১২ জুলাই উৎপাদন শুরু করে ভোলার ৩৪.৫ মেগাওয়াট রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। ভেঞ্চার এনার্জি নামক কেন্দ্রটির লাইসেন্স প্রাথমিকভাবে তিন বছরের জন্য দেয়া হয়েছিল। তবে ১৩ বছর পরিচালনার পর এ কেন্দ্রের চুক্তি পুনরায় নবায়ন করা হয়েছে। এ সময় আরও চার বছর বাড়ানো হয় চুক্তির মেয়াদ। এতে ১৭ বছর পর্যন্ত চলবে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। অর্থাৎ বিদ্যুৎকেন্দ্রটির আয়ুষ্কাল বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৬৭ শতাংশ।

একই অবস্থা আশুগঞ্জের ৫৩ মেগাওয়াট কেন্দ্রটির। ইউনাইটেড এনার্জি নামক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল তিন বছরের জন্য। সেটি ২০১১ সালের ২২ জানুয়ারি উৎপাদন শুরু করে। তবে ১০ বছর পরিচালনার পর সে চুক্তি আবারও নবায়ন করা হয়েছে। এ সময় কেন্দ্রটির মেয়াদ আরও পাঁচ বছর বাড়ানো হয়েছে। এতে কেন্দ্রটি চলবে ১৫ বছর। অর্থাৎ বিদ্যুৎকেন্দ্রটির আয়ুষ্কাল বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০০ শতাংশ।

শুধু এ দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রই নয়, মোট ১১টি রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ এভাবেই দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে। এতে তিন বা পাঁচ বছরের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চলবে ১২ থেকে ১৭ বছর পর্যন্ত। একইভাবে দুটি এসআইপিপির (স্মল ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) মেয়াদও বাড়ানো হয়েছে। যদিও এসব রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য বসিয়ে রাখতে হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বড় আইপিপি (ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) বিদ্যুৎকেন্দ্র। আর রেন্টাল-কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ কিনতে গিয়ে বছরে গচ্চা গেছে দুই হাজার ৭২৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ক্যাপাসিটি চার্জই গেছে ৫৯৪ কোটি টাকা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম ঊর্ধ্বমুখী। আবার সংকটের কারণে গ্যাসচালিত বড় কেন্দ্রগুলোও বসিয়ে রাখতে হচ্ছে। এতে মেয়াদোত্তীর্ণ বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর চুক্তি বারবার নবায়ন বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য বোঝা হয়ে উঠেছে। এছাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো নির্মাণের জন্য ২০১০ সালে বিশেষ আইন প্রণয়ন করা হয়, যা এগুলোকে পরিবেশ আইন থেকেও অব্যাহতি দেয়। এতে বারবার চুক্তি নবায়ন পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাবও ফেলছে।

তথ্যমতে, কুমারগাঁও ৫০ মেগাওয়াট এনার্জিপ্রিমা বিদ্যুৎকেন্দ্রটির লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল তিন বছরের জন্য। ২০০৮ সালের ২৩ জুলাই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি উৎপাদন শুরু করে। তবে ১০ বছর পরিচালনার পর সে চুক্তি আবারও নবায়ন করা হয়েছে। এতে কেন্দ্রটি চলবে ১৪ বছর তিন মাস। অর্থাৎ বিদ্যুৎকেন্দ্রটির আয়ুষ্কাল বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৮০ শতাংশ।

একই অবস্থা বগুড়ায় ২০ মেগাওয়াটের এনার্জিপ্রিমা বিদ্যুৎকেন্দ্রটির। এ কেন্দ্রটিরও লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল তিন বছরের জন্য। ২০১১ সালের ১৩ নভেম্বর বিদ্যুৎকেন্দ্রটি উৎপাদন শুরু করে। তবে ১০ বছর পরিচালনার পর সে চুক্তি আবারও তিন বছরের জন্য নবায়ন করা হয়েছে। এতে কেন্দ্রটি চলবে ১৩ বছর। অর্থাৎ বিদ্যুৎকেন্দ্রটির আয়ুষ্কাল বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৩৩ শতাংশ।

একইভাবে ১১৫ মেগাওয়াটের কেপিসিএল-২ (খুলনা পাওয়ার কোম্পানি) বিদ্যুৎকেন্দ্রটির লাইসেন্সও দেয়া হয়েছিল তিন বছরের জন্য। ২০১১ সালের ১ জানুয়ারি বিদ্যুৎকেন্দ্রটি উৎপাদন শুরু করে। তবে ১০ বছর পরিচালনার পর সে চুক্তি আবারও দুই বছরের জন্য নবায়ন করা হয়েছে। এতে কেন্দ্রটি চলবে ১২ বছর। অর্থাৎ বিদ্যুৎকেন্দ্রটির আয়ুষ্কাল বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০০ শতাংশ।

আবার ফেঞ্চুগঞ্জের ৫০ মেগাওয়াটের এনার্জিপ্রিমা বিদ্যুৎকেন্দ্রটির আয়ুষ্কাল বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০০ শতাংশ। এ কেন্দ্রটিরও লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল তিন বছরের জন্য। ২০১৫ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি বিদ্যুৎকেন্দ্রটি উৎপাদন শুরু করে। তবে কয়েক দফা চুক্তি নবায়নের পর কেন্দ্রটি চলবে ১২ বছর। আর ২৬০ শতাংশ আয়ুষ্কাল পর্যন্ত চলবে প্রিসিশন এনার্জির আশুগঞ্জের ৫৫ মেগাওয়াট রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। পাঁচ বছরের জন্য লাইসেন্স দেয়া কেন্দ্রটি উৎপাদন শুরু করে ২০১০ সালের ৭ এপ্রিল। ১০ বছর চালানোর পর আরও তিন বছর বাড়ানো হয়েছে আয়ুষ্কাল। এতে ১৩ বছর বছর চলবে কেন্দ্রটি।

একইভাবে ২৪০ শতাংশ আয়ুষ্কাল পর্যন্ত চলবে সামিটের ১০২ মেগাওয়াট মদনগঞ্জ, ওরিয়নের ১০০ মেগাওয়াট মেঘনাঘাট, নোয়াপাড়ার ৪০ মেগাওয়াটের কেপিসিএল-৩ এবং ওরিয়নের সিদ্ধিরগঞ্জ ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র চারটি। কেন্দ্র চারটি উৎপাদন শুরু করে যথাক্রমে ২০১১ সালের ১ এপ্রিল, ৮ মে, ২৯ মে ও ২৪ জুলাই। চারটি কেন্দ্রই ৫ বছরের জন্য লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল। তবে ১০ বছর করে পরিচালনার পর কেন্দ্র চারটির মেয়াদ আরও দুই বছর করে বাড়ানো হয়েছে। এতে কেন্দ্র চারটির আয়ুষ্কাল বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১বছর।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মধ্যে ভোলার ৩৪.৫ মেগাওয়াট কেন্দ্রটির ক্যাপাসিটি চার্জ ৩২ কোটি টাকা, আশুগঞ্জের ৫৩ মেগাওয়াট কেন্দ্রটির ক্যাপাসিটি চার্জ ৯১ কোটি টাকা, বগুড়ায় ২০ মেগাওয়াট কেন্দ্রটির ক্যাপাসিটি চার্জ ১৮ কোটি টাকা, ফেঞ্চুগঞ্জের ৫০ মেগাওয়াট কেন্দ্রটির ক্যাপাসিটি চার্জ ৪৭ কোটি ও কুমারগাঁও ৫০ মেগাওয়াট কেন্দ্রটির ক্যাপাসিটি চার্জ ৪৩ কোটি টাকা।

এদিকে ফার্নেস অয়েলচালিত খুলনার ১১৫ মেগাওয়াট কেন্দ্রের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে ১৫৮ কোটি টাকা, মদনগঞ্জ ১০২ মেগাওয়াট কেন্দ্রটির ক্যাপাসিটি চার্জ ৯২ কোটি টাকা, মেঘনাঘাট ১০০ মেগাওয়াট কেন্দ্রটির ক্যাপাসিটি চার্জ ৯৩ কোটি টাকা, নোয়াপাড়া ৪০ মেগাওয়াট কেন্দ্রটির (কেপিসিএল-৩) ক্যাপাসিটি চার্জ ৬০ কোটি টাকা ও সিদ্ধিরগঞ্জ ১০০ মেগাওয়াট কেন্দ্রটির ক্যাপাসিটি চার্জ ১৩১ কোটি টাকা।

জানতে চাইলে বাংলাদেশের বৈদেশিক দেনাবিষয়ক কর্মজোটের (বিডব্লিউজিইডি) সদস্য সচিব হাসান মেহেদী শেয়ার বিজকে বলেন, রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তির মেয়াদ (পাওয়ার পারচেজ এগ্রিমেন্ট তথা পিপিএ) নিরাপদ অপারেশন লাইফটাইমের আড়াই থেকে তিনগুণ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। মেয়াদোত্তীর্ণ রেন্টাল কেন্দ্রগুলো চালু রাখায় রাষ্ট্রীয় ও বড় আইপিপি কেন্দ্রগুলো বসিয়ে রাখতে হচ্ছে। আবার মেয়াদোত্তীর্ণ ও পুরোনো এসব কেন্দ্রের জন্য বছরে বড় অঙ্কের অর্থ গচ্চা যাবে।

উল্লেখ্য, রেন্টাল-কুইক রেন্টালের পাশাপাশি দুটি এসআইপিপির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। উভয় কেন্দ্রই সামিটের আর উৎপাদন সক্ষমতাও ১১ মেগাওয়াট করে। আশুগঞ্জ ও চান্দিনার কেন্দ্র দুটি উৎপাদন শুরু করে ২০০৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর। ১৫ বছরের এ কেন্দ্র দুটির মেয়াদ আরও পাঁচ বছর করে বাড়ানো হয়েছে। এতে কেন্দ্র দুটি ২০ বছর পর্যন্ত উৎপাদনে থাকবে। অর্থাৎ আয়ুষ্কাল বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩৩ শতাংশ।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০