Print Date & Time : 19 June 2025 Thursday 2:29 am

‘এখানেই শান্তিতে আছি’

হামিদুর রহমান, দুবাই থেকে ফিরে :‘দেশত তো ইসকে (রিকশা) চলাবার পাই না। ক্ষ্যাতে কাজ কইরা পরিবার চালাইতে পারতাম না। এহানে ক্লিনার কোম্পানিতে চাকরি করি, আট-নয় ঘণ্টা ডিউটি। এইডা শেষ করে পার্টটাইম আরেকটা কাজ করি। মাস শেষে বাড়িতে ৩০ হাজার পাঠায় দেই। ছেলেডা এইবার ম্যাট্রিক পাস করছে। ভালা কলেজোত ভর্তি করাইছি। ছোট আরেকটা মেয়ে আছে ওর মা-ই কইছে ওরে ডাক্তারি লাইনে পড়ামু’Ñএভাবেই দিন বদলের গল্প বলছিলেন কুড়িগ্রামের আরব-আমিরাত প্রবাসী বিল্লাল হোসেন।

পাশেই বসে থাকা রংপুরের আরেক প্রবাসী সোহেল রানা। তিনি বলেন, ‘দেশে বাপের জমিজমা আছে। বাড়িতে থাকতে জমিতেই কাজ করতাম। চার বছর হলো দুবাইতে এসেছি। দেশে জমিতে ধান চাষ করে সংসার সামলাতে মাঝে মাঝে ঋণ করতে হতো। আল্লাহর রহমতে এখন ঋণ করতে হচ্ছে না। বাড়িতে দুই মেয়ে, এক ছেলে। বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। গ্রামে নতুন একটা ঘর তুলতেছি। ঘরের কাজ শেষ হলেও ছোট মেয়েটাও বিয়ে দেবো। ছেলেটা নবম শ্রেণিতে পড়ে। নিজের সংসার চালিয়ে বাড়িতে বয়স্ক বাবা-মাকেও টাকা দেয়। তারাও শান্তিতে আছেন। বর্তমানে আল্লাহ যতটুকুই সামর্থ্য দিয়েছে এগুলো বিদেশে এসেছিলাম বলেই করতে পেরেছি।’  

সকালের ঝলমলে রোদে প্রবাসী বিল্লাল হোসেন আর সোহেল রানার সঙ্গে কথা শেষে ডেইরা দুবাই থেকে রইনা হলাম। গন্তব্য শারজাহ। শুনেছি সেখানেও অনেক প্রবাসী বাঙালি কাজ করেন। শারজাহ সৌদিয়া পার্কের একটু সামনে এগোতেই রাস্তার পাশে বড় করে লেখা বাংলাদেশি হোটেল। ততক্ষণে দুপুর টাইম ভাবলাম। হোটেলে প্রবেশ করতেই ক্যাশ থেকে বলছে কিতা খবর ভাই। বালানি… হো ভাই বালা। সেখানে বাঙালিসহ পাকিস্তানিদের আনাগোনাই বেশি। দোকানে বিক্রিও ভালো।

এই হোটেল কাজ করেন ১২ জন। তার মধ্যে ৮ জন বাংলাদেশি, দুইজন পাকিস্তানি, দুইজন নেপালি। হোটেল মালিক আওলাদ হোসেন। তার বাড়ি সিলেটে। ১২ বছরের প্রবাসী জীবনে শারজাহতে হোটেল ব্যবসা করছেন ৮ বছর।

হোটেলে আরেক বাংলাদেশি মিলন মিয়া। তার সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘দেড় বছর হলো এই দেশে এসেছি। ঢাকায় প্রাণ কোম্পানিতে চাকরি করেছি তিন বছর। এখানে পরিশ্রম বেশি। তবে আয়ও বেশি। দেশে চাকরির বাজার ভালো না। বেসরকারি চাকরি পেতেও অনেক ঘুরতে হয়। সব দিক থেকেই এখানে দেশের চেয়ে ভালো আছি। হোটেলে এই চাকরির পাশাপাশি পার্টটাইম কাজ করে মাস থেকে ৫০ হাজার টাকা আয় করছি। আগে আত্মীয়রা খুব খোঁজ নিতো না, এখন সবার সঙ্গে সম্পর্ক ভালো।’

আরব আমিরাতের দুবাই, শারজাহ, আবুধাবি, খোরফাক্কানসহ বেশ কয়েকটি লোকেশনে প্রবাসীদের সঙ্গে কথা হলে এবং মাঝে মাঝে অনেক নেতিবাচক খবর দেখা যায় বিদেশে শ্রমিকরা অনেক কষ্টে আছে ঠিকঠাক বেতন পায় না, থাকার জায়গা নেই, খেতে পায় না এসব বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তারা জানায়, ‘নেগেটিভ বিষয়গুলো খুব বেশি ছড়িয়ে পড়ে। আর এখানে পরিশ্রম করতে পারলে টাকার অভাব নেই। কেউ কেউ ভাবে বিদেশে এসে নিজের মনের মতো কাজ করবে না, পেলে করবে না এমন ভাবনা যাদের আছে তাদের আরব আমিরাত কেন, পৃথিবীর কোনো জায়গায় ভালো কিছু করতে পারবে না। এখানে অনেক শ্রমিক আছেন যারা কমশিক্ষিত, পড়াশোনা করেনি রিকশা, আর ক্ষেত কাজ ছাড়া কিছু করতে পারে না তারাও এখানে ভালো টাকা আয় করছেন।’

১২ বছর ধরে আরব আমিরাতের শারজাহতে থাকছেন নোয়াখালীর কবির মিয়া। তার কাছেও বিষয়গুলো জানতে চাইলে তিনিও বলেন, ‘আমাদের রাজধানী ঢাকাতেও কিন্তু সবাই ভালো নেই। যাদের বুদ্ধি আছে তারা কেউ চাকরি করছে, কেউ ব্যবসা করছে। ঢাকায় তো বসে খাওয়ার জায়গা না। পৃথিবীর যে দেশেই যান সব জায়গায় কাজ করতে হয়। পরিশ্রম করতে জানলে আরব আমিরাতে পয়সার অভাব নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘অনেক লোক আছেন যারা দালাল ধরে আছেন। এক কাজের কথা বলে আরেক কাজে দেয়, আবার কাউকে কাজই দেওয়া হয় না। যারা দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে আছে তারা খুব সুবিধা করতে পারে না। এমন মানুষগুলোর এখানে কষ্ট করতে হয়।’