হাল বিশ্বের খোঁজখবর যারা রাখেন, তাদের অজানা থাকার কথা নয় যে, বাংলাদেশের প্রবাসী আয় কমেছে সম্প্রতি। নিঃসন্দেহে আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতিই এর প্রধান কারণ। তবে আরও যেসব কারণ রয়েছে, সেগুলো মূল না হলেও গুরুত্বপূর্ণ। আর সেগুলোর মধ্যে হুন্ডির মাধ্যমে লেনদেন অন্যতম। দেশে এ অপচর্চাটি চলে আসছে বহুদিন ধরে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তথা সরকার এ ব্যাপারে বারবার সতর্ক করে দিয়েছে সংশ্লিষ্টদের। তাতে কাজ হয়নি বলা যাবে না। তবে হুন্ডি থেকে প্রবাসীরা যে মাত্রায় সরে আসবেন বলে প্রত্যাশা করা হয়েছিল, সেটি ঘটেনি। উল্টো বেশ কিছুদিন ধরে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মতো আধুনিক সেবা ব্যবহৃত হচ্ছে এ অপকর্মটিতে। এমন অভিযোগের প্রমাণ মেলার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যবস্থাও নিচ্ছে। গতকালের শেয়ার বিজে খবর রয়েছে হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স বিতরণের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান বিকাশের দুই হাজার ৮৮৭ এজেন্টের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। অবৈধভাবে প্রবাসী আয় তথা রেমিট্যান্স বিতরণের সঙ্গে নাকি যুক্ত ছিল এগুলো। এদিকে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ ও সন্ত্রাসবিরোধী আইন ব্যবহারপূর্বক বেনামে হিসাব পরিচালনাকারী ৮০ হাজার এজেন্টের ছয় লাখ হিসাবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে বলে খবরে প্রকাশ। অতীতেও হুন্ডির বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর অবস্থান আমরা দেখেছি। তবু সঙ্গত কারণে কেউ কেউ সংশয়মুক্ত হতে পারছেন না ওসবে আসলে কাজ হবে কতটা। তাতে আবার দেশে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সম্ভাবনা কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কি না, তা নিয়েও দুর্ভাবনা রয়েছে তাদের।
খেয়াল করা দরকার, বেশ কিছু ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে স্থানীয়ভাবে। তার মাঝে ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী বিকাশ ও ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের রকেটই অধিক জনপ্রিয়। বিশাল বাজারে মাত্র দুটি মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের উপস্থিতির সুবিধা-অসুবিধা উভয় দিকই রয়েছে। সুবিধা হলো, এদের নিয়ন্ত্রণ করা সহজ। আর সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো, এতে অলিগোপলির সুযোগ সৃষ্টি হতে পারেÑযা বাজারে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার পরিবেশ নিশ্চিতকরণের অন্তরায়। ভালো হতো মোবাইল ব্যাংকিংয়ে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও উঠে এলে। দুর্ভাগ্যবশত তেমন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না আপাতত। এ অবস্থায় ওই দুই প্রতিষ্ঠানের অধিক দায়িত্বশীল হয়ে ওঠার বিকল্প নেই। আর ব্যাংকিং কার্যক্রমে তাদের আচরণ যেন অধিকতর দায়িত্বশীল হয়, সেটি তদারক করতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংককেই। প্রবাসীদের আরও কীভাবে বৈধ পথে অর্থ প্রেরণে উৎসাহিত করা যায়Ñতাও বিবেচনায় রাখা দরকার। কেননা প্রবাসীরা যতক্ষণ পর্যন্ত না নিজে থেকে রেমিট্যান্স প্রেরণে অনুপ্রাণিত হচ্ছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত হুন্ডি নির্মূল প্রায় অসম্ভব। লক্ষণীয়, প্রচলিত ব্যাংকিং চ্যানেল কেন জানি প্রবাসীদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে পারছে না। ফলে বিপুলসংখ্যক প্রবাসী হুন্ডির মাধ্যমেই দেশে অর্থ প্রেরণে আগ্রহী। অথচ আমাদের মনে এ নিয়ে কোনো দ্বিধা নেই যে, হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রেরণ সঙ্গত নয় ও তা অবৈধ। প্রবাসীরা এ বিষয়ে অবগত নন, তা মানতে নারাজ অনেকে। সমস্যা হলো, এরপরও তারা ‘অনুভব’ করছেন হুন্ডির মাধ্যমেই অর্থ প্রেরণ শ্রেয়। কেন এমন মনোভাব তৈরি হলো খতিয়ে দেখা দরকার। তা কি নিছক সাংস্কৃতিক কারণে, নাকি এর পেছনে ব্যাংক খাতের কোনো দুর্বলতা রয়েছেÑতা অনুসন্ধান জরুরি। নইলে সামগ্রিক অর্থনীতিতে রেমিট্যান্সের কাক্সিক্ষত প্রভাব পড়বে না।
Add Comment