Print Date & Time : 30 June 2025 Monday 10:07 pm

এজেন্টের মাধ্যমে ব্যাংকিং করছে সাড়ে ১৪ লাখ মানুষ

মেহেদী হাসান: ব্যাংকিং সুবিধা বঞ্চিতদের জন্য চালু হওয়া এজেন্ট ব্যাংকিং খুব দ্রুত প্রসার লাভ করছে। যেখানে ব্যাংকের কোনো শাখা নেই, ওইসব এলাকায় ব্যাংকিং সুবিধা দিতে চালু হয় এ সেবা। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের সেবা পেতে গ্রাহককে বাড়তি কোনো চার্জ দিতে হয় না। রয়েছে নানাধর্মী সুবিধাও। ফলে দ্রুত জনপ্রিয় হচ্ছে এজেন্ট ব্যাংকিং। প্রতিনিয়ত বাড়ছে গ্রাহকসংখ্যা, বাড়ছে লেনদেনও।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, চলতি বছরের মার্চ শেষে এজেন্ট ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ১৬টি ব্যাংকের মাধ্যমে খোলা মোট হিসাবসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৬৮ হাজার ৭৯৭টি। অর্থাৎ এজেন্টের মাধ্যমে ব্যাংকিং সুবিধার আওতায় এসেছে সাড়ে ১৪ লাখের বেশি মানুষ। এসব হিসাবে মোট আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৬৩৪ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। হিসাবপ্রতি গড়ে ১১ হাজার ১২৭ টাকা আমানত জমা হয়েছে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর শেষে মোট আমানতের পরিমাণ ছিল এক হাজার ৩৯৯ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। চলতি বছরের মার্চে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৬৩৪ কোটি ৩৬ লাখ টাকা।
এদিকে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ব্যাংকগুলো তাদের কার্যক্রম শুধু হিসাব খোলা, পরিচালনা করা ও রেমিট্যান্স বিতরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেনি, বরং ঋণ বিতরণের মাধ্যমে আয়-উৎসারী কর্মকাণ্ডকে উৎসাহিত করে গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা সচল রাখার ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। চলতি বছরের মার্চ শেষে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ছয়টি ব্যাংক তাদের ঋণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু করেছে। ছয়টি ব্যাংক সর্বমোট ১২২ কোটি ২৫ লাখ টাকা ঋণ বিতরণ করেছে।
আর্থিক খাতের বিশ্লেষকরা বলছেন, জনবহুল বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখার অন্যতম প্রেক্ষাপট হিসেবে এজেন্ট ব্যাংকিং একটি ফলপ্রসূ উদ্যোগ। স্বল্প ব্যয়ে ব্যাংকিং সেবা প্রদানের একটি আধুনিক ও সময়োপযোগী বিকল্প চ্যানেল হলো এজেন্ট ব্যাংকিং। আউটলেট পরিচালনার মাধ্যমে ব্যাংকগুলো প্রান্তিক জনসাধারণকে সীমিত আকারে সব ধরণের ব্যাংকিং সেবা প্রদানের পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ আমানত সংগ্রহ করছে, যা সংশ্লিষ্ট এলাকায় ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতিশীলতা আনয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিক রাখবে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনেও এজেন্ট ব্যাংকিং সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে তারা আশা প্রকাশ করেছেন।
প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেটের মাধ্যমে খোলা মোট হিসাবসংখ্যার ৬০ শতাংশ হিসাব ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের। দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে ব্যাংক এশিয়া এবং আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক। ডাচ্-বাংলা ব্যাংকে সর্বোচ্চ আট লাখ ৮৪ হাজার ৬৮০টি হিসাব খোলা হয়েছে। এর পরেই তিন লাখ ৮০ হাজার ৯৩৬টি হিসাব ব্যাংক এশিয়া এবং ৮৩ হাজার ৭৮৪টি আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকে। অন্যদিকে আমানতের পরিমাণে শীর্ষে রয়েছে আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক এবং আমানত বৃদ্ধির পরিমাণে শীর্ষে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক। এছাড়া ১১৭ কোটি ১০ লাখ টাকা ঋণ বিতরণ করে শীর্ষে রয়েছে ব্যাংক এশিয়া। ঋণ বিতরণে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে আল্-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক এবং তৃতীয় অবস্থানে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক।
তথ্যমতে, ব্যাংকগুলোর এজেন্ট আউটলেটের মাধ্যমে গ্রাহকদের ইনওয়ার্ড রেমিট্যান্স সেবা প্রদানে এজেন্ট ব্যাংকিং বেশ কার্যকর মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীকে রেমিট্যান্স সেবা প্রদানে এজেন্ট ব্যাংকিং অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। ব্যাংকের শাখার মতো এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেটগুলো তুলনামূলকভাবে সহজ পদ্ধতিতে ও দ্রুততম সময়ে এ সেবা প্রদান করছে। মার্চ শেষে সর্বমোট দুই হাজার ৬৭৩ কোটি ৯৯ লাখ টাকা রেমিট্যান্স প্রদান করা হয়েছে।
এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনাকারী ব্যাংকগুলো হলোÑডাচ্-বাংলা ব্যাংক; ব্যাংক এশিয়া; আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক; সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক; মধুমতি ব্যাংক; মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক; এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক; স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক; অগ্রণী ব্যাংক; ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক; মিডল্যান্ড ব্যাংক; দি সিটি ব্যাংক; ইসলামী ব্যাংক; দি প্রিমিয়ার ব্যাংক; ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক ও এবি ব্যাংক।
জানা গেছে, সম্প্রতি ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক ও এবি ব্যাংক কর্তৃক এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু করায় বর্তমানে ১৬টি ব্যাংক এর সর্বমোট তিন হাজার ২১৬টি এজেন্টের আওতায় চার হাজার ৯০৫টি আউটলেটের মাধ্যমে সারা দেশে এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা প্রদান করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা মোতাবেক প্রায় সব ব্যাংক গ্রাম ও শহরে আউটলেট স্থাপনের অনুপাত ৩:১ অনুসরণ করছে। এজেন্ট আউটলেটের সংখ্যার দিক থেকে ব্যাংক এশিয়া শীর্ষে অবস্থান করছে।
ব্যাংক কর্মকর্তারা জানান, এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে নতুন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা, অ্যাকাউন্টে টাকা জমা ও উত্তোলন, টাকা স্থানান্তর (দেশের ভেতর), রেমিট্যান্স উত্তোলন, বিভিন্ন মেয়াদি আমানত প্রকল্প চালু, ইউটিলিটি সার্ভিসের বিল পরিশোধ, বিভিন্ন ধরনের ঋণ উত্তোলন ও পরিশোধ এবং সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় সরকারি সব ধরনের ভর্তুকি গ্রহণ করা যায়। এজেন্টরা কোনো চেকবই বা ব্যাংক কার্ড ইস্যু করতে পারেন না। এজেন্টরা বিদেশ-সংক্রান্ত কোনো লেনদেনও করতে পারেন না। এছাড়া এজেন্টদের কাছ থেকে কোনো চেকও ভাঙানো যায় না। এজেন্টরা মোট লেনদেনের ওপর কমিশন পেয়ে থাকেন।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৩ সাল থেকে এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম গ্রহণ করে। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মূল লক্ষ্য বাণিজ্যিক ব্যাংক কর্তৃক এজেন্ট নিয়োগের মাধ্যমে জনগণকে ব্যয়সাশ্রয়ী, নিরাপদ ও আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর ব্যাংকিং সেবা প্রদানের মাধ্যমে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতিশীলতা আনয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্য বিমোচন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করা। এছাড়া গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে এজেন্ট ব্যাংকিং বেশ জনপ্রিয় এবং কার্যকর একটি মাধ্যম। ২০১৮ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত ২০টি তফসিলি ব্যাংককে এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১৬টি ব্যাংক মাঠপর্যায়ে এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সম্প্রতি ব্র্যাক ব্যাংক এবং এনআরবি ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার অনুমোদন গ্রহণ করেছে।