রোহান রাজিব: দেশের ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণে নাজুক পরিস্থিতি। খেলাপি ঋণ বাড়লেও আদায় বাড়ছে না। অর্থঋণ আদালতে মামলা করেও আদায় হচ্ছে না খেলাপি ঋণের অর্থ। বরং অর্থঋণ আদালতে খেলাপি ঋণের মামলার স্তূপ হচ্ছে। কিন্তু নানা কারণে এসব মামলা নিষ্পত্তিও হচ্ছে কম।
অন্যদিকে আদালতের বাইরে বিকল্প বিরোধ (এডিআর) ব্যবস্থায়ও মামলা নিষ্পত্তিতে কাক্সিক্ষত গতি নেই। আবার যেসব মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে, সেগুলোর বিপরীতে আদায়ের হারও নগণ্য। তাই এই এডিআর পদ্ধতিতে মামলা নিষ্পত্তি বাড়াতে তিন সুপারিশ করা হয়েছে।
এগুলো হলোÑএক. খেলাপি গ্রাহকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার আগে গ্রাহকের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা ও সদিচ্ছা বিবেচনায় গ্রাহক বরাবর পাওনা অর্থ পরিশোধের নোটিশ ইস্যু করার সময় ব্যাংক কর্তৃক এডিআর পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তির প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত করা। দুই. মধ্যস্থতাকে ফলপ্রসূ করতে বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল আরবিট্রেশন সেন্টোরসহ (বিআইএসি) অনুরূপ প্রতিষ্ঠান অথবা অবসরপ্রাপ্ত বিচারক, ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, আইনজীবী অথবা অন্য যে কোনো উপযুক্ত ব্যক্তিকে ব্যাংক ও গ্রাহক উভয়পক্ষের সম্মতিতে মধ্যস্থতাকারী ব্যক্তি হিসেবে নির্বাচন। তিন. মধ্যস্থতার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তি না হলে এক্ষেত্রে উভয়পক্ষের সম্মতিতে আরবিট্রেশনের সাহায্যও নেয়া এবং আরবিট্রেশন প্রক্রিয়ায় বিলম্ব এড়াতে ব্যাংকগুলো বিআইএসিসহ এরূপ অন্যান্য আরবিট্রেশন সেন্টারের সঙ্গে সমঝোতা সম্পাদন। তবে গ্রাহকের অনাগ্রহে বা অন্য কোনো কারণে এডিআর পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তি সম্ভব না হলে ব্যাংক পাওনা অর্থ আদায়ে যথারীতি আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, খেলাপি ঋণের পাওনা দ্রুত আদায়ের লক্ষ্যে ব্যাংকগুলো কর্তৃক বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার ব্যত্যয় না ঘটিয়ে কিছুটা ছাড় দেয়া হলে ঋণগ্রহীতারা এ পদ্ধতিতে অংশ নিতে আগ্রহী হবে। তবে আলোচ্য প্রক্রিয়াকে কোনোভাবেই যেন সময়ক্ষেপণের কৌশল হিসেবে ব্যবহার করা না হয়, সে বিষয়ে ব্যাংকগুলোকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে অর্থঋণ আদালতে বিভিন্ন ব্যাংক নতুন মামলা দায়ের করেছে সাত হাজার ৪৩২টি। এসব মামলায় জড়িত অর্থের পরিমাণ প্রায় ১১ হাজার ১৯১ কোটি টাকা। একই সময়ে আদালতের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়েছে আট হাজার ৪৪২টি। এর বিপরীতে আদায় হয়েছে মাত্র ৭৮৮ কোটি টাকা। ফলে সেপ্টেম্বর শেষে অর্থঋণ আদালতে পুঞ্জীভূত মামলার সংখ্যা কিছুটা কমে দাঁড়িয়েছে দুই লাখ চার হাজার ২৯৬টিতে। এসব মামলার বিপরীতে আটকে আছে দুই লাখ ১২ হাজার ১৫৭ কোটি টাকা।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত জুন পর্যন্ত অর্থঋণ আদালতে চলমান ক্রমপুঞ্জীভূত মামলার সংখ্যা ছিল ৭২ হাজার ৫৪০টি, যার বিপরীতে ব্যাংকগুলোর দাবির পরিমাণ এক লাখ ৭৮ হাজার ২৭০ কোটি টাকা।
অন্যদিকে গত জুন পর্যন্ত এডিআর পদ্ধতিতে ১৩ হাজার ১৯৯টি মামলার মধ্যে ১০ হাজার ৫৪৫টি নিষ্পত্তি হয়েছে। এর বিপরীতে আদায় হয়েছে মাত্র ৯৯৬ কোটি টাকা, যা আলোচ্য মামলাগুলোর দাবীকৃত অর্থের মাত্র ১৫ দশমিক ৮০ শতাংশ।
আজ বুধবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে দেশের সব ব্যাংকের অনুষ্ঠিত ব্যাংকার্স সভায় এ-সংক্রান্ত দুটি প্রতিবেদন উপস্থাপনের কথা রয়েছে। সভায় খেলাপি ঋণের মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির মাধ্যমে ঋণ আদায় কার্যক্রমকে আরও গতিশীল করতে ব্যাংকগুলোকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেবেন গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার। এছাড়া সভায় বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি পদ্ধতিতে খেলাপি ঋণের মামলা নিষ্পত্তি বাড়াতে নতুন পদক্ষেপ নেয়ার ওপর জোর দেয়া হবে।
জানা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের কৌশলগত পরিকল্পনা ২০২০-২০২৪-এর আইন বিভাগ সংশ্লিস্ট অবজেকটিভ ৯-৪ (বি)-এর অ্যাকশন প্লান-জি অংশে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মামলাধীন খেলাপি ঋণ নজরদারির বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত আছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কৌশলগত পরিকল্পনার ওই লক্ষ্য বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণ হ্রাসের লক্ষ্যে মামলাধীন ঋণগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে আইন বিভাগ থেকে নিয়মিত তদারকি করার সিদ্ধান্ত হয়। সে অনুযায়ী এ-সংক্রান্ত মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে ব্যাংকগুলোকে নিয়মিত নির্দেশনা, পরামর্শ ও বিবিধ সহায়তা করা হচ্ছে। তারপরও ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ আদায়-সংক্রান্ত মামলার নিষ্পত্তি হচ্ছে কম। এর কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রয়োজনের তুলনায় অর্থঋণ আদালতের সংখ্যা কম হওয়া ও বিচারকের অভাব এবং আইনি মতামতের জন্য ব্যাংকের আইনজীবীকে পর্যাপ্ত সময় ও সহায়ক জামানতের পর্যাপ্ত দলিলাদি সরবরাহ করতে না পারায় অর্থঋণ আদালতে মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা দেখা দেয়। অন্যদিকে খেলাপি ঋণ আদায়ে এডিআর ব্যবস্থার আওতায় মধ্যস্থতাকারী যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারছে না।
ফলে দেখা যাচ্ছে, এডিআর পদ্ধতিতে দায়েরকৃত মামলার পরিমাণ ও নিষ্পত্তিকৃত মামলায় আদায় হার এখনও উল্লেখযোগ্য নয়। অর্থাৎ খেলাপি ঋণ আদায়ে মধ্যস্থতাকারী যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারছে না।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অর্থঋণ আদালত আইন, ২০০৩-এর ধারা ২২-২৫ অনুসারে মধ্যস্থতা বা আপস মীমাংসার মাধ্যমে আদালতের বাইরে বিরোধ নিষ্পত্তি ও ঋণ আদায়ের সুযোগ রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে যোগ্য মধ্যস্থতাকারী না পাওয়া ও পক্ষগুলোর মতভেদ দূর না হওয়া প্রভৃতি কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মধ্যস্থতার উদ্যোগ ফলপ্রসূ হয় না। এক্ষেত্রে বিরোধীয় পক্ষগুলোর সম্মতিতে নির্বাচিত ব্যক্তির তুলনায় মধ্যস্থতা সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানে যুক্ত পেশাদার ও দক্ষ মধ্যস্থ ব্যক্তির সেবাগ্রহণ অধিকতর ফলপ্রসূ হতে পারে। এছাড়া ঋণের পাওনা অর্থ আদায়ে আরবিট্রেশনের সাহায্য নেয়ার সুযোগও রয়েছে।