ইসমাইল আলী: এক দশকের বেশি সময় ধরে দেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় যে পরিবর্তন এসেছে তা হলো, কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ। এ সময় কৃষি খাতে পুরুষ শ্রমিকের সংখ্যা কমেছে, বেড়েছে নারীর নিয়োজন। তবে গত কয়েক বছরে এ চিত্র পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। এ সময়ে কৃষি খাতে নারীর অংশগ্রহণ কমেছে। বেড়েছে শিল্প খাতে কর্মসংস্থান। তিন বছরের ব্যবধানে শিল্পে নারীর অংশগ্রহণ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। পাশাপাশি সেবা খাতেও নারীর অংশগ্রহণ কিছুটা বেড়েছে।
গত মাসে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) প্রকাশিত ‘ওমেন অ্যাট ওয়ার্ক’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর লেবার ফোর্স সার্ভে ২০১০ ও ২০১৩’র ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি প্রণয়ন করে সংস্থাটি।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০১০ সালে কর্মে নিয়োজিত নারীর হার ছিল ৩৬ শতাংশ। ৪ কোটি ৭৭ লাখ ২৮ হাজার কর্মক্ষম নারীর মধ্যে ১ কোটি ৭১ লাখ ৭৪ হাজার সে সময় কর্মে নিয়োজিত ছিল। ২০১৩ সালে নারীর কর্মে নিয়োজনের হার কমে। ওই সময় কর্মক্ষম নারীর সংখ্যা ছিল ৫ কোটি ৪২ লাখ ৯ হাজার। আর কর্মে নিয়োজিত ছিল ১ কোটি ৮১ লাখ ৫৫ হাজার। অর্থাৎ ২০১৩ সালে দেশে কর্মক্ষম নারীর ৩৩ দশমিক ৫০ শতাংশ বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত ছিল।
২০১০ সালে কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ ছিল ১ কোটি ৫ লাখ ৬ হাজার। ২০১৩ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৯০ লাখ ৮ হাজারে। অর্থাৎ তিন বছরের ব্যবধানে কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ কমেছে প্রায় ১৫ লাখ বা ১৪ দশমিক ২৬ শতাংশ। এদিকে ২০১০ সালে শিল্পে নারীর অংশগ্রহণ ছিল ১৯ লাখ ৭ হাজার। ২০১৩ সালে এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৩৭ লাখ ৮২ হাজার। অর্থাৎ তিন বছরে শিল্পে নারীর অংশগ্রহণ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি ও নিটল নিলয় গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা আহ্মাদ শেয়ার বিজকে বলেন, আগে মেয়েদের কাজ করার বিষয়ে পারিবারিক বাধা ছিল। কিন্তু এখন প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মেয়েরা শহরে এসে কাজ করছেন। তাদের বেতন-ভাতা গ্রামে পাঠিয়ে পরিবারে স্বাচ্ছন্দ্য আনছেন। এতে নারীর ক্ষমতায়নের পাশাপাশি সামাজিক পরিবর্তনও এসেছে।
এডিবির তথ্যমতে, এছাড়া ২০১৩ সালে সেবা খাতে নিয়োজিত শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ৩৮ লাখ ৯৭ হাজার, ২০১০ সালে যা ছিল ৩৬ লাখ ৯৭ হাজার। অর্থাৎ তিন বছরের ব্যবধানে সেবা খাতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে ২ লাখ। এর মধ্যে শিক্ষা খাতে নারীর নিয়োজন দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। পাশাপাশি সামাজিক সেবা, স্বাস্থ্য কর্ম ও আর্থিক খাতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে।
কৃষিতে নিয়োজিত নারীর শিক্ষার হার কম হলেও শ্রমে নিয়োজিত নারীর মধ্যে শিক্ষার হার বেশি। কৃষি খাতে নিয়োজিত শ্রমিকের ৪৬ শতাংশ প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেছে। আর মাধ্যমিক পর্যায় উন্নীতের সংখ্যা ২১ শতাংশ। তবে ২৭ শতাংশ অশিক্ষিত। আর শিল্পে নিয়োজিত নারীদের মাত্র ১২ শতাংশ অশিক্ষিত। আর ২৫ শতাংশ প্রাথমিক ও ৪৯ শতাংশ মাধ্যমিক পর্যায়ে উত্তীর্ণ।
এদিকে তৈরি পোশাক ছাড়াও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, তামাকজাত পণ্য, টেক্সটাইল, চামড়াজাত পণ্য ও অধাতব (নন-মেটালিক) খনিজ পণ্য ও ওষুধ শিল্পে নারীর অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য। ২০১৩ সালে তৈরি পোশাক খাতে নারীর অংশগ্রহণ ছিল ১৭ লাখ ৬৫ হাজার ৯৮৫ জন। এরপর রয়েছে টেক্সটাইল ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে। এ দুই খাতে নিয়োজিত রয়েছেন যথাক্রমে ২ লাখ ৩৩ হাজার ১১১ ও ৬৩ হাজার ৮৮৪ নারী। এছাড়া অধাতব খনিজ শিল্পে ৫৫ হাজার, তামাকজাত পণ্যে ৩৪ হাজার ৬৫৪, চামড়াজাত পণ্যে ২২ হাজার ৬৪ ও ওষুধ শিল্পে প্রায় ১০ হাজার নারী নিয়োজিত আছেন।
বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ কার্যালয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, অনেকের ধারণা নারীর দক্ষতার অভাব রয়েছে, যা সম্পূর্ণ অমূলক। গার্মেন্ট ও টেক্সটাইল শিল্পে নারীরা তা প্রমাণ করেছে। এছাড়া কৃষিতেও নারী দক্ষতার প্রমাণ রাখছে। কারণ নারী শ্রমিকের অংশগ্রহণ বাড়ায় প্রতি বছর কৃষিতে উৎপাদন বাড়ছে। ব্যাংক-বীমাসহ অন্যান্য পেশায় নারীরা ভালো করছে। তাই শিল্পে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে পুরুষের কর্মসংস্থানের হার ৮২ আর নারীর মাত্র ৩২ শতাংশ; উন্নত দেশগুলোয় যা অনেক বেশি। নারীর কর্মসংস্থান আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ৭৫ শতাংশে উন্নীত করতে পারলে দেড় শতাংশ হারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়বে। এক্ষেত্রে শিল্প খাত বিশেষত প্রশাসনিক পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে, যা কাজে লাগাতে হবে।
Add Comment