আবদুল হাকিম আবির: শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিতে প্রশিক্ষিত শিক্ষকের বিকল্প নেই। এজন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে থাকে। তবে এ প্রশিক্ষণ পর্যাপ্ত নয়, তার প্রমাণ মেলে বিভিন্ন সূচকে। এগুলোয় দেখা যায়, বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থার সব স্তরেই রয়েছে প্রশিক্ষিত শিক্ষকের সংকট। এতে একদিকে ব্যাহত হচ্ছে পাঠদান, অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের জ্ঞানার্জনও অসম্পূর্ণ থাকছে।
প্রশিক্ষিত শিক্ষকের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কতটা পিছিয়ে আছে, তা উঠে এসেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সম্প্রতি প্রকাশিত ‘কি ইন্ডিকেটরস ফর এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিক ২০১৭’ শীর্ষক প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক এ তিন স্তরেই প্রশিক্ষিত শিক্ষকের সূচকে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান তলানিতে।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, প্রাথমিকে ৩২টি দেশের মধ্যে প্রশিক্ষিত শিক্ষকের সূচকে বাংলাদেশ ৩০তম স্থানে রয়েছে। প্রাথমিকে বাংলাদেশে প্রশিক্ষিত শিক্ষকের হার মাত্র ৪৪ শতাংশ। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে এ সূচকে বাংলাদেশের পরে আছে শুধু পালাউ ও ভানুয়াতু। দেশ দুটিতে প্রশিক্ষিত শিক্ষক রয়েছে যথাক্রমে ৩২ ও ২৬ শতাংশ।
এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ১৫টি দেশে প্রাথমিকে শতভাগ প্রশিক্ষিত শিক্ষক রয়েছে। আর দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে প্রাথমিকে সবচেয়ে বেশি প্রশিক্ষিত শিক্ষক রয়েছে ভুটানে। দেশটিতে শতভাগ প্রশিক্ষিত শিক্ষক রয়েছে এ স্তরে। এছাড়া নেপালে ৯৮ শতাংশ, মালদ্বীপে ৮৪, পাকিস্তানে ৮২, ভারতে ৭৭ ও শ্রীলঙ্কায় ৭১ শতাংশ প্রশিক্ষিত শিক্ষক রয়েছে।
শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, শিক্ষাব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ স্তরগুলোতে প্রশিক্ষিত শিক্ষকের এ সংকট শিক্ষাব্যবস্থার পাশাপাশি সামগ্রিকভাবে দেশের উন্নয়নকেও বাধাগ্রস্ত করে। এ অবস্থায় সব স্তরে প্রশিক্ষিত শিক্ষক নিশ্চিতকরণ গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশিক্ষত শিক্ষক সংকটকে শিক্ষাব্যবস্থার জন্য দুর্যোগ উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক হোসনে আরা বেগম শেয়ার বিজকে বলেন, দক্ষ জনশক্তি ও প্রশিক্ষিত শিক্ষক আমাদের জাতীয় উন্নয়নের একটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ। শিক্ষক প্রশিক্ষণ কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও কার্যত এখনও কাক্সিক্ষত ফল অর্জিত হয়নি। এ অবস্থায় কার্যকর পরিকল্পনার আলোকে শিক্ষকসমাজকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যোগ্য করে তুলতে না পারলে এ সংকট শিক্ষাব্যবস্থার জন্য দুর্যোগ হিসেবে আবিভর্‚ত হবে।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রশিক্ষিত শিক্ষকের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৯টি দেশের মধ্যে ১৬তম। এ স্তরে দেশের ৬০ শতাংশ শিক্ষক প্রশিক্ষিত। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে আছে পালাউ, শ্রীলঙ্কা ও ভানুয়াতু। দেশ তিনটিতে মাধ্যমিকে প্রশিক্ষিত শিক্ষক রয়েছে যথাক্রমে ৫৯, ৫৮ ও ২২ শতাংশ।
এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সাতটি দেশে মাধ্যমিক স্তরে শতভাগ প্রশিক্ষিত শিক্ষক রয়েছে। এর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার ভুটানও রয়েছে। এছাড়া মালদ্বীপের ৯২ শতাংশ, নেপালে ৯০ ও পাকিস্তানে ৬২ শতাংশ শিক্ষক প্রশিক্ষিত।
এদিকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে প্রশিক্ষিত শিক্ষকের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫টি দেশের মধ্যে ১৩তম। শিক্ষার এ স্তরে ৫৭ শতাংশ শিক্ষক প্রশিক্ষিত। এ সূচকে বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে আছে কিরিবাটি ও ভানুয়াতু। দেশ দুটিতে প্রশিক্ষিত শিক্ষক রয়েছে যথাক্রমে ৩৬ ও ২০ শতাংশ।
এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে পাঁচটি দেশে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে শতভাগ প্রশিক্ষিত শিক্ষক রয়েছে। আর দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে নেপালের ৯২ ও ভুটানের ৭২ শতাংশ শিক্ষক প্রশিক্ষিত।
প্রশিক্ষিত শিক্ষক সংকটের কারণ হিসেবে শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা সরকারের অপরিকল্পিত শিক্ষানীতিকেই দায়ী করছেন। তারা মনে করছেন, আমাদের শিক্ষানীতিতে শিক্ষকদের যথাযথভাবে প্রশিক্ষিত করে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় কর্মপরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, গুণগত শিক্ষা অর্জনের জন্য ল্যাবরেটরি, লাইব্রেরি, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম, অবকাঠামোসহ অনেক বিষয়ের সঙ্গে প্রয়োজনীয় ও প্রশিক্ষিত শিক্ষকের দরকার রয়েছে। প্রশিক্ষিত শিক্ষক না থাকলে শিক্ষার গুণগতমান অর্জনে ঝুঁকি থেকে যায়। কিন্তু অনাকাক্সিক্ষতভাবে যথাযথ পরিকল্পনার অভাবে আমাদের চলমান শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষকরা প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ পান না।
শিক্ষার প্রতিটি স্তরে প্রশিক্ষিত শিক্ষকের সংকটের কারণ হিসেবে শিক্ষক অনুপাতে অধিক শিক্ষার্থী থাকাকে দায়ী করছেন সরকারের কর্তাব্যক্তিরা। তারা বলছেন, শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে সব শিক্ষকের প্রশিক্ষণমূলক প্রোগ্রামের আওতায় নিয়ে আসার সুযোগ হয় না।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের সচিব সোহরাব হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, উল্লিখিত রিপোর্টগুলোয় প্রশিক্ষিত শিক্ষকের তথ্য-উপাত্তের সঙ্গে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাতকেও আমলে নেওয়া হয়। ছাত্র-শিক্ষকের অনুপাতের কাক্সিক্ষত অবস্থা থেকে আমরা এখনও অনেক দূরে। শিক্ষকের চেয়ে আমাদের শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় সামগ্রিকভাবে প্রশিক্ষিত শিক্ষকের সংখ্যাও কমছে। আমরা বুঝতে পারছি, আমাদের শিক্ষকদের আরও বেশি করে প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। আশার বিষয় হচ্ছে, আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা থাকা সত্তে¡ এ নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কাজ করছে।
Add Comment