এনইএস ট্রেডিংয়ের ৬ বছরে ১২ কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকি

হামিদুর রহমান: অফিস বা জনবল না থাকলেও কাগজে-কলমে নামসর্বস্ব কোম্পানি খুলে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক থেকে ৫৩ কোটি টাকা লোন তুলে নিয়ে নিয়েছে এনইএস ট্রেডিং (নেস)। মূলত ডেনিম এশিয়ার অর্থ লুটসহ ভ্যাট-ট্যাক্স ফাঁকি ও ভুয়া ব্যাংক লোন নিতেই কৌশলে শুধু কাগুজে এই প্রতিষ্ঠানটি খোলা হয়েছে। জনবল না থাকলেও এই প্রতিষ্ঠানের ভুয়া কর্মকর্তা-কর্মচারী দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা লুটের অভিযোগ উঠেছে এনইএস ট্রেডিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়ান জোবায়েরের বিরুদ্ধে। অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানটি গত ছয় বছরে প্রায় ১২ কোটি ১২ লাখ টাকার ভ্যাট ও এআইটি ফাঁকি দিয়েছে।

নেস ট্রেডিংয়ের এক নথিতে দেখা যায়, ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি ভ্যাট ও এআইটি ফাঁকি দিয়েছে প্রায় ১২ কোটি ১১ লাখ ২৩ হাজার টাকা। এর মধ্যে ২০১৮ সালে নেসের বিক্রি দেখানো হয়েছে সাত কোটি ২৩ লাখ তিন হাজার ২০০ টাকা, যার বিপরীতে ভ্যাট দাঁড়ায় প্রায় ৫৪ লাখ ২২ হাজার ৭৪০ টাকা। যেটি না দিয়ে ফাঁকি দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। একই সময়ে ক্রয় দেখানো হয়েছে পাঁচ কোটি ১৩ লাখ ৫১৫ টাকা। বিপরীতে এআইটি দাঁড়ায় প্রায় ২৫ লাখ ৬৫ হাজার ২৬ টাকা, যেটি ফাঁকি দেয়া হয়েছে। ২০১৯ সালে বিক্রি দেখানো হয়েছে সাত কোটি পাঁচ লাখ ৭৭ হাজার ৫১০ টাকা, যার বিপরীতে ভ্যাট ফাঁকি দেয়া হয়েছে প্রায় ৫২ লাখ ৯৩ হাজার ৩১৩ টাকা। একই সময়ে মালামাল ক্রয় দেখানো হয়েছে পাঁচ কোটি সাত লাখ ৬১ হাজার টাকা, বিপরীতে এআইটি ফাঁকি দেয়া হয়েছে প্রায় ২৫ লাখ ৩৮ হাজার টাকা। অর্থাৎ ভ্যাট ও এআইসি বাবদ ফাঁকি দেয়া হয়েছে ৭৮ লাখ ৩১ হাজার ৩৬৮ টাকা।

এছাড়া ২০২০ সালে প্রতিষ্ঠানটির বিক্রি দেখানো হয়েছে প্রায় সাত কোটি ৮০ লাখ ৩০ হাজার ৯২১ টাকা, আর ক্রয় দেখানো হয়েছে প্রায় পাঁচ কোটি ৩৬ লাখ ৪০ হাজার ২১৮ টাকা। বিপরীতে ভ্যাট ও এআইটি বাবদ ফাঁকি দেয়া হয়েছে প্রায় ৮৫ লাখ ৩৪ হাজার ৩৩০ টাকা। ২০২১ সালে বিক্রি দেখানো হয়েছে প্রায় ১৮ কোটি ১৩ লাখ ২৬ হাজার ৪১৫ টাকা, আর ক্রয় দেখানো হয়েছে ২০ কোটি পাঁচ লাখ ৫১ হাজার ৮১১ টাকা। বিপরীতে ভ্যাট ও এআইটি বাবদ ফাঁকি দেয়া হয়েছে দুই কোটি ৩৬ লাখ ২৭ হাজার টাকা।

২০২২ সালে বিক্রি দেখানো হয়েছে ২০ কোটি ২২ লাখ ৬৫ হাজার ৪২১ টাকা, আর ক্রয় দেখানো হয়েছে প্রায় ১৭ কোটি ৯০ লাখ ৩৯ হাজার ৫৭৭ টাকা। বিপরীতে ভ্যাট ও এআইটি বাবদ ফাঁকি দেয়া হয়েছে প্রায় দুই কোটি ৪১ লাখ ২১ হাজার ৮৮৫ টাকা। এদিকে ২০২৩ সালে প্রতিষ্ঠানটি বিক্রি দেখিয়েছে প্রায় ৪০ কোটি ৭৪ লাখ ৮৫ হাজার ৫৩৪ টাকা, আর ক্রয় দেখানো হয়েছে প্রায় ৩৬ কোটি ৯২ লাখ দুই হাজার ৯৭৯ টাকা। বিপরীতে ভ্যাট ও এআইটি বাবদ ফাঁকি দেয়া হয়েছে প্রায় চার কোটি ৯০ লাখ ২১ হাজার ৫৬৪ টাকা।
এ বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ‘কর অঞ্চল ১০’-এ যোগাযোগ করা হলে তারা বলেন, এনইএস ট্রেডিং ২০২১-২২, ২০২২-২৩, ২০২৩-২৪Ñতিন বছরের অডিট রিপোর্ট দাখিল করেছে। বিষয়গুলো নিয়ে মামলা রয়েছে, যেটি এখনও নিষ্পত্তি হয়নি। আইন অনুযায়ী, দুই বছরের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করতে হবে। প্রতিষ্ঠান নিষ্পত্তি করতে ব্যর্থ হলে তখন আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সরেজমিনে দেখা যায়, এনইএস ট্রেডিংয়ের বাস্তবে কোনো অফিস ও জনবল নেই। ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার সময় ডেনিম এশিয়ার অফিসকেই কৌশলে এনইএস ট্রেডিংয়ের অফিস হিসেবে দেখানো হয়। এমনটি ডেনিম এশিয়ার কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও এনইএসের কর্মকর্তা-কর্মচারী হিসেবে দেখানো হয়।
তথ্যমতে, এনইএস ট্রেডিংয়ের (নেস) বাস্তবে কোনো অফিস বা জনবল না থাকলেও কেবল কাগজে-কলমে কোম্পানি দেখিয়ে ইউসিবি ব্যাংকের সঙ্গে যোগসাজশে সায়ান জোবায়ের প্রায় ৫৩ কোটি টাকা টাকা লোন নেন। ডেনিম এশিয়া নামের কোম্পানির অফিসেই ছোট সাইনবোর্ড পর্যন্তই সীমাবদ্ধ এটির কার্যক্রম। ২০২৩ সালের ৩১ অক্টোম্বর ইউসিবি ব্যাংকের নর্থ গুলশান ব্র্যাঞ্চ থেকে এই লোনটি পাশ হয়। সম্প্রতি আওয়ামী লীগের পতন ঘটলে কৌশলে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান কোম্পানির মালিক সায়ান জোবায়ের। বর্তমানে তিনি লন্ডনে অবস্থান করছেন বলেও জানা গেছে।

যাচাই-বাছাই ছাড়া কীভাবে এত টাকা লোন পাস হলো, সে বিষয়ে ইউসিবি ব্যাংকের নর্থ গুলশান ব্র্যাঞ্চে যোগাযোগ করা হলে তারা জানান, সেই সময় যে ম্যানেজার এই লোন পাস করেছেন তিনি এখানে নেই। হেড অফিসের পারমিশন ছাড়া এ বিষয়ে আমরা আর কোনো তথ্য দিয়ে পারব না।
এনইএস ট্রেডিংয়ের (নেস) পরিচালক সায়ান জোবায়েরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে লন্ডন থেকে শেয়ার বিজকে তিনি হোয়াসটঅ্যাপে বলেন, ‘আমাদের চেয়ে অনেক ছোট ছোট ব্যবসায়ীরও অনেক অনেক অনিয়ম থাকে। আমাদের যে লোন আছে, সেটি আমরা আগামী ছয় মাসের মধ্যে সেটেল করব।
তবে ভ্যাট ফাঁকি ও অর্থ পাচারের বিষয়ে আবারও জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই।

জানা যায়, আওয়ামী লীগের অর্থ লোপাটকারীদের ছত্রছায়ায় হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন সায়ান জোবায়েরের বাবা নিউ এশিয়া গ্রুপের পরিচালক এএফএম জোবায়ের। এদিকে নিউ এশিয়া গ্রুপ থেকে বর্তমানে আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যাংকঋণ, নিয়মিত ভ্যাট-ট্যাক্স ফাঁকি দেয়া থেকে শুরু করে বিপুল অর্থ পাচারের অভিযোগ উঠেছে এএফএম জোবায়েরের দুই ছেলে সায়ান জোবায়ের ও সাফওয়ান জোবায়েরের বিরুদ্ধে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এক্সেরা সোয়েটার ও এডব্লিউআর নামের একটি কোম্পানি ব্যাংক থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা লোন নিয়ে আত্মসাৎ করে, যে কোম্পানির মালিক আদনান ইমাম। ব্যাংক লুটেরা এই আদনান ইমামের ব্যবসায়িক পার্টনার সায়ান জুবায়ের, যিনি নেসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এনইএস ট্রেডিং ছাড়াও ডেনিম এশিয়া, নিউ এশিয়ার, এক্সোরা সোয়েটার, এডব্লিওআরের পরিচালনা পর্ষদে আছেন সায়ান জোবায়ের ও তার ছোট ভাই সাফওয়ান জোবায়ের।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, গত কয়েক বছরে শত কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগ রয়েছে কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়ান জোবায়েরের বিরুদ্ধে।

দুদকসহ দেশের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা এসব প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয় ও সম্পদের অনুসন্ধান করলে সব তথ্য বের হয়ে আসবে বলেও জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা আরও বলেন, এসব অনিয়মের দায় ব্যাংক ও এনবিআর এড়াতে পারে না। তাদেরও জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। অনেক ব্যবসায়ী ও আমলা আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বহুভাবে অর্থ হাতিয়েছে। এখানে যাদের সংশ্লিষ্টতা আছে, তাদেরও তদন্তসাপেক্ষে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০