সাধন সরকার: গোপালগঞ্জের তাপস হালদার এনটিআরসিএ’র (বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ) তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তিতে সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার এমপিওভুক্ত বিদ্যালয়ে সহাকারী শিক্ষক (সামাজিক বিজ্ঞান) হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন গত ফেব্রুয়ারিতে। সাকুল্যে তিনি বেতন পান ১২ হাজার ৭৫০ টাকা। গোপালগঞ্জে বাবা-মা আর স্ত্রী-সন্তান থাকে। বাবা অসুস্থ। দূরবর্তী জেলায় চাকরি হওয়ায় পরিবারের খরচ পাঠিয়ে অর্থসংকটের মধ্যে নিজে বিদ্যালয়ের পাশের একটি মেসে থাকেন।
শামীমের বাড়ি চট্টগ্রামে। দ্বিতীয় গণবিজ্ঞপ্তিতে তিনি সহকারী শিক্ষক (বাংলা) হিসেবে চাকরি পেয়েছেন রংপুর সদরের একটি এমপিওভুক্ত বিদ্যালয়ে। বিএড ডিগ্রি না থাকায় তিনিও সাকুল্যে বেতন পান ১২ হাজার ৭৫০ টাকা। বাড়িতে বাবা-মামা, ছোট বোন ও স্ত্রী। চাকরির সুবাদে অনেক সমস্যার মধ্যেও মো. শামীমকে থাকতে হচ্ছে রংপুরে।
উল্লিখিত ঘটনা সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত দু’জন এমপিওভুক্ত শিক্ষকের (রূপক নাম ব্যবহার করা হয়েছে)। এমন উদাহরণ হাজার হাজার। হাজার হাজার শিক্ষক (সরকার কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত) এনটিআরসিএ’র মাধ্যমে গত তিন গণবিজ্ঞপ্তিতে নিজ উপজেলা-জেলার বাইরে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে (স্কুল, মাদ্রাসা, কারিগরি স্কুল ও কলেজ) সুপারিশপ্রাপ্ত হয়ে সামান্য বেতনে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। হঠাৎ চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশের (এনটিআরসিএ কর্তৃক বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৭০ হাজারের বেশি শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি) আগ মুহূর্তে এসে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্র্তৃক গত ১৪ নভেম্বর পরিপত্র জারি করে ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের (এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত) বদলি কার্যক্রমের নীতিমালার ৭ নংধারা (এক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন) রহিত করা হয়েছে। যার ফলে নিজ উপজেলা-জেলার বাইরে চাকরিপ্রাপ্ত এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জন্য মহাসংকটের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর আগে এমপিওভুক্ত ইনডেক্সধারী শিক্ষকরা গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদনের মাধ্যমে এক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য প্রতিষ্ঠানে বদলি হতে পারতেন। এই সুযোগ এনটিআরসিএ তৈরি করে দিয়েছিল। কেননা নীতিমালা অনুযায়ী এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের নিজ উপজেলা-জেলায় নিয়োগ পাওয়ার কথা। বিভিন্ন সমস্যার কারণে শিক্ষকদের নিয়োগের বেলায় উপজেলা-জেলা-বিভাগীয় কোটা মানা হয়নি। ফলে বিগত তিনটি গণবিজ্ঞপ্তিতে হাজার হাজার শিক্ষক নিজ উপজেলা-জেলা-বিভাগের বাইরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পেয়ে বদলি হওয়ার জন্য মুখিয়ে আছেন। প্রশ্ন হলো, গণবিজ্ঞপ্তিতে নিবন্ধিত সাধারণ চাকরিপ্রত্যাশীদের সঙ্গে ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের বদলি যদি বাতিল-ই করা হবে তাহলে আগের গণবিজ্ঞপ্তিতে সুযোগ দেয়া হয়েছিল কেন? শত শত কিলোমিটার দূরবর্তী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দিয়ে শিক্ষকদের সমস্যায় ফেলা হলো কেন? হঠাৎ করে বদলি আইনের ধারা বাতিল না করে সমস্যার সমাধান কি করা যেত না?
গণবিজ্ঞপ্তিতে ইনডেক্সধারী শিক্ষকরা বদলি হওয়ার ফলে ওই প্রতিষ্ঠানে স্বাভাবিকভাবে পদ শূন্য হয়ে যায়। এই সমস্যা সমাধানে দ্রুত শূন্য পদের তথ্য সংগ্রহ করে দ্বিতীয় ধাপে চাকরিপ্রত্যাশীদের সুপারিশ করে শূন্যপদ পূরণ করা যেত। কিন্তু এনটিআরসিএ কর্তৃপক্ষ সে পথে না যাওয়ায় শূন্য পদ বারবার শূন্যই থেকে গেছে। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেমন তৈরি হয়েছে শিক্ষকসংকট তেমন নিবন্ধিত বেকার চাকরিপ্রত্যাশীরা বেকারই রয়ে গেছে। ঘুরেফিরে ইনডেক্সধারীরাই বদলি হয়েছে বারবার। তাই বোধ করি গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের আচমকা বদলি বাতিলের সিদ্ধান্ত ভালোর জন্যই! তবে সময়ের পরিক্রমায় পদ্মা-মেঘনা-যমুনায় অনেক জল গড়িয়েছে। ইতোমধ্যে এনটিআরসিএর কর্র্তৃপক্ষের সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত না নেয়ার ফলে হাজার হাজার শিক্ষক দূরবর্তী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছে। এসব হাজার হাজার শিক্ষক সামান্য বেতনে কোনো রকমে চাকরিটা বাঁচিয়ে মানবেতর জীবনযাপনের মধ্যে আসন্ন গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বদলির আশায় দিন গুনছেন। গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে দূরবর্তী প্রতিষ্ঠানে নিয়োগপ্রাপ্ত ইনডেক্সধারী শিক্ষকরা অবশ্যই বদলি হওয়ার দাবি রাখে। তা না হলে এনটিআরসিএ বিগত গণবিজ্ঞপ্তিতে বদলির পদ্ধতি চালু করত না। এনটিআরসিএ’র ভুলে ইনডেক্সধারী শিক্ষকরা খেসারত দেবে কেন? অন্য সব প্রতিষ্ঠানে বদলি কার্যক্রম থাকলে সরকারের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে কেন? সামান্য বেতনে পরিবার-পরিজন থেকে দূরবর্তী এলাকায় চাকরি করে শিক্ষকদের পক্ষে মানসম্মত শিক্ষাদান করা কী সম্ভব?
ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের বদলির বিষয়ে দ্রুত শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে দিকনির্দেশনা আসা উচিত। ইনডেক্সধারী শিক্ষকরা বদলির জন্য তথা আসন্ন গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদনের সুযোগ পেতে এনটিআরসিএ ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় বরাবর স্মারকলিপি প্রকাশ, মানববন্ধন ও গণ-অনশনের মতো কর্মসূচির মাধ্যমে দাবির যৌক্তিকতা জানান যাচ্ছেন। এনটিআরসিএ কর্তৃপক্ষ আসন্ন চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তিতে ইনডেক্সধারী শিক্ষক ও নিবন্ধিত সাধারণ চাকরিপ্রত্যাশীদের নিয়োগে উভয় স্বার্থ রক্ষা করতে চাইলে নি¤েœর দুটি পদ্ধতির থেকে যেকোনো একটি পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারে।
পদ্ধতি ১: আসন্ন গণবিজ্ঞপ্তিতে আগের মতো ইনডেক্সধারী শিক্ষক ও নিবন্ধিত সাধারণ চাকরিপ্রত্যাশীদের আবেদনের সুযোগ দিয়ে চূড়ান্ত সুপারিশ করার পর বদলির মাধ্যমে শূন্য হয়ে যাওয়া পদগুলোতে দ্রুত তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে দ্বিতীয় ধাপে নিবন্ধিত সাধারণ চাকরিপ্রত্যাশীদের সুপারিশ করতে পারে। এতে করে কোনো শিক্ষক পদ আর ফাঁকা পড়ে থাকবে না।
পদ্ধতি ২: গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের আগে বদলির সুযোগ প্রদান করে তথা ইনডেক্সধারীদের বদলি কার্যক্রম শেষে শূন্যপদের তথ্য সংগ্রহ করার পর অতঃপর নিবন্ধিত সাধারণ চাকরিপ্রত্যাশীদের জন্য গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করলে কোনো পদ পদ্ধতিগত কারণে আর শূন্য পড়ে
থাকবে না।
উল্লেখিত যেকোনো একটি পদ্ধতি অনুসরণ করলে কোনো সমস্যা ছাড়াই সহজে উভয় কূল রক্ষা হবে। শিক্ষকসংকট দূর হবে। বদলি কার্যক্রম বাদ দিয়ে তথা ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের সমস্যার মধ্যে রেখে বর্তমান সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। কেননা আসন চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তিতে নতুন নিয়োগ পাওয়া হাজার হাজার শিক্ষক আবারও দূরবর্তী এলাকায় নিয়োগ পাবে। সামান্য বেতনে দূরবর্তী এলাকা ছেড়ে নিজ এলাকায় আসতে সদ্য নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকরাও স্বাভাবিকভাবে বদলির দাবি তুলবে। তাই আগে বদলির বিষয়ে যৌক্তিক সমাধান সময়ের দাবি। এ ব্যাপারে সব দিক বিবেচনা করে শিক্ষক ও শিক্ষাদানের জন্য ইতিবাচক হয় এমন সিদ্ধান্ত নিতে এনটিআরসিএ ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
শিক্ষক ও পরিবেশকর্মী