নিজস্ব প্রতিবেদক: আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নির্ধারিত ব্যালান্স অব পেমেন্ট বা বিপিএম-৬ পদ্ধতিতে গত এপ্রিল শেষে বাংলাদেশের নিট ইন্টারন্যাশনাল রিজার্ভ (এনআইআর) নেমে যায় ১২ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারে। ২০২৩ সালের জুন শেষে যা ছিল ১৯ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার। সে হিসাবে ১০ মাসে নিট রিজার্ভ কমেছে ৬ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার।
গত সোমবার বাংলাদেশের অনুকূলে ঋণের তৃতীয় কিস্তি ছাড়ের অনুমোদন দেয় আইএমএফ। এর পরপরই বাংলাদেশের অর্থনীতির বিভিন্ন দিক নিয়ে মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। সে প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ ছাড়া বাকি সব শর্ত পূরণ করেছে বাংলাদেশ। আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর নাগাদ বৈদেশিক মুদ্রার নিট রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৭ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার। ওই সময় বাংলাদেশের নিট রিজার্ভ ছিল ১৬ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলার।
এতে আরও বলা হয়েছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের গ্রস ইন্টারন্যাশনাল রিজার্ভ (জিআইআর) দাঁড়াবে ১৮ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলার, যা দিয়ে ২.৩ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে। গত ১৯ জুন শেষে গ্রস রিজার্ভ ছিল ১৯ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার। যদিও আইএমএফের ঋণের তৃতীয় কিস্তি পাওয়ায় রিজার্ভের পরিমাণ আরও কিছুটা বাড়বে।
এদিকে চলতি অর্থবছর শেষে নিট রিজার্ভ দাঁড়াতে পারে ১৪ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার। এই পরিমাণ রিজার্ভ দিয়ে ১.৮ মাসের আমদানি ব্যয় মেটাতে সক্ষম হবে বলে প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়। অথচ দুই বছর আগে ২০২২ সালের জুনে নিট রিজার্ভ ছিল ২৮ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলার। ওই পরিমাণ রিজার্ভ দিয়ে ৪.২ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যেত। আর ২০২৩ সালের নিট রিজার্ভ দিয়ে ২.৯ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যেত। অর্থাৎ বাংলাদেশের আমদানি সক্ষমতা ক্রমেই কমছে।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, অনেক শর্ত পূরণ করলেও ঋণ কর্মসূচি শুরুর পর আইএমএফের বেঁধে দেয়া রিজার্ভের ত্রৈমাসিক কোনো লক্ষ্যমাত্রাই পূরণ করতে পারেনি বাংলাদেশ। বারবার ব্যর্থ হওয়ার পর আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল, তৃতীয় কিস্তির অর্থ পাওয়া যায় কি না। যদিও বাংলাদেশের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে আইএমএফের প্রতিনিধিদল গত মাসে রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে আনে। তবে সেটিও পূরণ করা বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠেছে।
চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য আইএমএফের বেঁধে দেয়া নিট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২০ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলার। তবে বাংলাদেশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তা কমিয়ে ১৪ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলারে নামিয়ে আনা হয়েছে।
এর আগে গত সেপ্টেম্বর শেষে নিট রিজার্ভ সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৭ দশমিক ৯৯ বিলিয়ন ডলার। তবে সে সময়ও রিজার্ভ সংরক্ষণে ব্যর্থ হয় বাংলাদেশ। গত বছর সেপ্টেম্বর শেষে নিট রিজার্ভ দাঁড়ায় ১৬ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলার।
এদিকে ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত দুই বছরে ৯টি দেশের রিজার্ভ সংরক্ষণের চিত্র প্রতিবেদনে তুলে ধরে আইএমএফ। এতে দেখা যায়, গত দুই বছরে রিজার্ভ সবচেয়ে বেশি কমেছে বাংলাদেশের। এছাড়া থাইল্যান্ড ও ফিলিপাইন্সের রিজার্ভ সামান্য কমেছে। একই সময় রিজার্ভ বেড়েছে ব্রাজিল, ভারত, মালয়েশিয়া এবং মেক্সিকোর। এ সময় রিজার্ভ পজিশন অপরিবর্তিত ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ইন্দোনেশিয়ার।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশের রিজার্ভ কমেছে প্রায় ৪৫ শতাংশ। একই সময় থাইল্যান্ডের রিজার্ভ কমেছে মাত্র পাঁচ শতাংশ ও ফিলিপাইন্সের তিন শতাংশের মতো। তবে প্রতিবেশী দেশ ভারতের রিজার্ভ বেড়েছে প্রায় পাঁচ শতাংশ ও মেক্সিকোর প্রায় ১০ শতাংশ। অন্যান্য দেশের রিজার্ভ সামান্য বেড়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি বহুমুখী চ্যালেঞ্জের মুখে আছে। বিশ্ববাজারে ধারাবাহিকভাবে পণ্যের উচ্চ মূল্য ও বৈশ্বিক আর্থিক খাতে অর্থপ্রবাহ কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির সংকট বেড়েছে। চলতি হিসাব সংকুচিত হলেও হঠাৎ আর্থিক হিসাবের ঘাটতি তৈরি হওয়ায় বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ও বিনিময় হারে চাপ পড়েছে। যদিও এ চাপ সামলাতে মুদ্রার বিনিময় হার সংশোধনের সাহসী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি হতে পারে ৯ দশমিক ৪ শতাংশ। পরের অর্থবছরে তা কমে ৭ দশমিক ২ শতাংশে নেমে আসতে পারে প্রক্ষেপণ করেছে আইএমএফ। নীতিগত ধারাবাহিকতা ও বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমে আসার সম্ভাবনার কারণে মূল্যস্ফীতি কমে আসতে পারে বলে মনে করছে আইএমএফ। তবে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের মধ্যেও অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা থাকবে বলে মনে করছে সংস্থাটি। এছাড়া চলতি অর্থবছর মোট দেশজ উৎপাদন তথা জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৪ শতাংশ হবে বলে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। তবে আগামী অর্থবছর তা বেড়ে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ হতে পারে।
এতে আরও বলা হয়েছে, মধ্যমেয়াদে বিনিময় হারসহ অন্য নীতিগুলো যথাযথভাবে কাজ করলে তথা রপ্তানি আয় প্রসারণ ও বৈচিত্র্য আনা এবং বিদেশি বিনিয়োগকে আকর্ষণ করা গেলে আগামী অর্থবছর শেষে নিট রিজার্ভ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়াবে ১৯ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলার ও ২০২৫-২৬ অর্থবছর শেষে আরও বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়াতে পারে ২৭ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের আমদানি ব্যয়ের যথাক্রমে ২.১ মাস ও ২.৭ মাসের চাহিদা মেটানো যাবে।