এফএএস ফাইন্যান্সের ৮৪ শতাংশই খেলাপি

জয়নাল আবেদিন: রেড জোনে থাকা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড। দীর্ঘদিন আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি। নানা অনিয়ম ও দুর্নীতিতে অভিযুক্ত এই প্রতিষ্ঠানটির মোট ঋণের ৮৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ খেলাপি হয়ে পড়েছে। ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় সঞ্চিতি বা প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ এখন ৩০৫ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। এমন পরিস্থিতিতেও প্রতিষ্ঠানটিকে মূল ধারায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন নবগঠিত পরিচালনা পর্ষদ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য বলছে, ২০২০ সাল পর্যন্ত এক হাজার ৯১৯ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে এফএএস ফাইন্যান্স। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে এক হাজার ৬১৯ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণের ৮৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ। এসব ঋণের মধ্যে বেশিরভাগ আবার আদায়-অযোগ্য অর্থাৎ কু-ঋণ। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, মোট খেলাপির মধ্যে ৪০৬ কোটি টাকাই মন্দ মানের খেলাপি, হিসাব অনুযায়ী যা মোট খেলাপি ৪৩ শতাংশ। ব্যাংকারদের মতে মন্দ মানের খেলাপির এই টাকা আদায়ের সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ।

সংশ্লিষ্ট সুত্র জানায়, এসব ঋণের বেশিরভাগ টাকাই গেছে পিকে হালদারের পকেটে। পিকে হালদারের বেনামি ৯ কোম্পানির নামে নেয়া হয়েছে মোট ঋণের ৫৮ শতাংশ, যার পরিমাণ এক হাজার ১১৮ কোটি টাকা। এসব ঋণ আদায় হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই বললে চলে। হালদার কাণ্ড প্রকাশের পর থেকে আমানত ফেরত নিতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন সাধারণ গ্রাহক। কিন্তু এখন সেসব টাকা ফেরত দেয়ার সামর্থ্য নেই প্রতিষ্ঠানটির।

বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণেও ব্যর্থ হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঝুঁকিপূর্ণ তালিকা বা রেড জোনে থাকা এই প্রতিষ্ঠানটি। ২০২০ সাল শেষে ৩০৫ কোটি ৬৬ লাখ টাকার প্রভিশন ঘাটতিতে পড়েছে এফএএস ফাইনান্স।

চলতি বছর ৩১ মে উদ্যোক্তাদের সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার না থাকাসহ নানা অনিয়ম ঠেকাতে ফাস ফাইন্যান্সের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়। ওইদিন একটি আদেশ জারির মাধ্যমে পর্ষদ পুনর্গঠন করে দেয় পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। পুনর্গঠিত পর্ষদের চেয়ারম্যান নিয়োগ করা হয় সাবেক ব্যাংকার, এনসিসি ও মেঘনা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ নুরুল আমিনকে। পর্ষদের স্বতন্ত্র সদস্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের শিক্ষক মোহাম্মদ সাইফ উদ্দিন খান, অবসর প্রস্তুতিকালীন ছুটিতে থাকা সেনা কর্মকর্তা আবু সৈয়দ মোহাম্মদ আলী, ঋণমান যাচাইকারী সংস্থা ক্রেডিট রেটিং ইনফরমেশন অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেডের (সিআরআইএসএল) উপ-প্রধান নির্বাহী সৈয়দ আবদুল্লাহ আল মামুন ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ক্যাপিটাল মার্কেটের ফ্যাকাল্টি মেম্বার মো. সেলিম।

বিষয়গুলো স্বীকার করে এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট নতুন চেয়ারম্যান নুরুল আমিন শেয়ার বিজকে জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের সব তথ্যই সঠিক। তবে নবগঠিত পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা মিলে আমরা প্রতিষ্ঠানটিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি। বর্তমানে আমরা প্রতিষ্ঠানটিকে ব্যক্তিগতভাবে এবং এক্সটার্নাল অডিটর দ্বারা পর্যবেক্ষণ করছি। আমরা চেষ্টা করছি যাতে প্রতিষ্ঠানটা নতুনভাবে ক্ষতিগস্ত না হয়। আমানতকারীদের আস্থা ফিরিয়ে তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটিকে তার ব্যবসায়িক ধারায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।

প্রসঙ্গত, তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগে কানাডায় পলাতক এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদারের (পিকে হালদার)। এরই মধ্যে চলতি বছর বেশ কয়েকটি মামলা হয়েছে পিকে হালদার ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে। বিভিন্ন হিসাবে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের কথা বলা হলেও দুদকের কাছে দেয়া বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের তথ্য থেকে জানা যায়, চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশান্ত কুমার হালদার সরিয়েছেন ১০ হাজার ২০০ কোটি টাকা।

বিএফইইউর তথ্যমতে, ফাস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড (এফএএস) থেকে দুই হাজার ২০০ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। এছাড়া বাকি তিনটি কোম্পানি হলো পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড থেকে তিন হাজার কোটি টাকা এবং রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেড থেকে দুই হাজার ৫০০ কোটি টাকা সরায় পিকে হালদার চক্র।

পিকে হালদার নিজে এবং তার নিকটাত্মীয়স্বজনের নামে ও বেনামে নতুন নতুন কোম্পানি খুলে ঋণ বা লিজ নেয়ার মাধ্যমে এই অর্থ আত্মসাৎ করেন। ফাস ফাইন্যান্সের ওপর পরিচালিত বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শন প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

২০০৮ সালে পুঁজিবাজারে আসা ‘বি’ ক্যাটেগরির কোম্পানিটির অনুমোদিত মূলধন ২১০ কোটি টাকা এবং পরিশোধিত মূলধন ১৪৯ কোটি ৭৭ হাজার টাকা। কোম্পানির মোট শেয়ারসংখ্যা ১৪ কোটি ৯০ লাখ ৭৭ হাজার ৩৬৪। মোট শেয়ারের মধ্যে ১৩ দশমিক ২০ শতাংশ উদ্যোক্তা বা পরিচালকদের হাতে, ১২ দশমিক ১৪ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক এবং ৭৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ শেয়ার রয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীর হাতে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০