নিজস্ব প্রতিবেদক: কভিড মহামারির কারণে গত দ্ইু বছর সীমিত পরিসরে অনুষ্ঠিত দুর্গাপূজা এবার উৎসবের রঙে ফিরছে। সারাদেশে এবার ৩২ হাজার ১৬৮টি মণ্ডপে পূজা উদ্যাপন করা হবে বলে বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদ জানিয়েছে। গত বছরের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এবার নিরাপত্তা নিশ্চিতে সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন পরিষদের নেতারা।
বাঙালি হিন্দুদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজার ঘণ্টা বাজবে ২৫ সেপ্টেম্বর মহালয়ার মধ্য দিয়ে। ১ অক্টোবর শুরু হবে মূল পূজা, যা ৫ অক্টোবর প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে। এবারের দুর্গোৎসব নিয়ে গতকাল শনিবার সকালে ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির মিলনায়তনে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় আসেন হিন্দুধর্মীয় নেতারা।
পরিষদের সভাপতি জেএল ভৌমিক বলেন, গত বছরের ঘটনার প্রেক্ষাপটে এ বছর সরকার চাচ্ছে, কোনো অবস্থাতেই যেন কোনো অঘটন না ঘটে। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা গত বছরের তুলনায় এ বছর অনেক বেশি সক্রিয়। আমরা মনে করি, আমাদের ৩২ হাজার ১৬৮টি মন্দিরের সুরক্ষা দেয়া খুব কঠিন। তাই আমরা এবছর প্রত্যেক মন্দিরে স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করছি, যারা রাতেও পাহারা দেবে।
গত বছর কুমিল্লায় একটি মণ্ডপে প্রতিমার ওপর কোরআন রাখার ঘটনায় বিভিন্ন মন্দির ও পূজামণ্ডপে হামলা, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ হয়। তার জেরে আরও কয়েকটি জেলায়ও হামলা হয় হিন্দুদের ওপর।
জেএল ভৌমিক বলেন, আমরা সম্পূর্ণভাবে নিরাপদ, একথা বলা যাবে না। ঘটনা ঘটতে পারে, তবে আমরা এবার খুব সচেতন। সর্বোচ্চ সিসিটিভির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। গ্রামে বিভিন্ন বার্তা পৌঁছে দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে সেই মন্দিরগুলো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ, যেগুলো অস্থায়ী মন্দির। স্থায়ী জায়গায় না হয়ে মাঠে, ময়দানে বা বিভিন্ন রাস্তাঘাটে যেসব মণ্ডপ স্থাপন করা হয়, সেগুলো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। সেখানে আমাদের বেশি বেশি পাহারা দিতে হবে এবং সারারাত বসে থাকতে হবে।
জেএল ভৌমিক আগামী নির্বাচনের আগেই ধর্মীয় সংখ্যালঘু সুরক্ষায় আইন প্রণয়ন করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণেই বারবার ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হচ্ছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ইশতেহারে সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইনের কথা বলা হয়েছে। আগামী নির্বাচনের আগেই এটা করতে হবে। আমরা বলেছি, এমন একটি আইন করতে হবে, যেমন এসিড নিক্ষেপ হতো বাংলাদেশেÑসেখানে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান করে স্পেশাল আইন করার ফলে, কিন্তু এটা একেবারেই কমে গেছে। আমাদের জন্যও এমন একটি আইন করতে হবে। যারা অপরাধী তাদের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান করতে হবে এবং স্পেশাল আদালতে কম সময়ের মধ্যে বিচার করতে হবে।
মতবিনিময় সভায় পূজা উদ্যাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক চন্দ্রনাথ পোদ্দার জানান, গত বছর সারাদেশে দুর্গাপূজার সংখ্যা ছিল ৩২ হাজার ১১৮টি। এবার এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২ হাজার ১৬৮টি। ঢাকা মহানগরে পূজার সংখ্যা ২৪১টি, যা গত বছরের থেকে ছয়টি বেশি।
তিনি বলেন, বর্তমান সরকার রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে আসার পর প্রতিবছর ধারাবাহিকভাবে পূজার সংখ্যা বাড়ছে। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও শুভানুধ্যায়ীদের অনুদান নিঃসন্দেহে পূজার সংখ্যা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে বলা যায়। পূজার সংখ্যা বৃদ্ধি নিশ্চয়ই আনন্দদায়ক। তবে পূজার
সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পূজাকেন্দ্রিক নিরাপত্তার বিষয়টিও সবাইকে বিবেচনায় নেয়া দরকার।
চন্দ্রনাথ পোদ্দার বলেন, পূজা, ঈদ, বড়দিন, বুদ্ধপূর্ণিমা প্রত্যেক সম্প্রদায়ের কাছে অত্যন্ত পবিত্র। আমরা এমন একটি সমাজের অপেক্ষায় আছি, যে সমাজে ঈদ-পূজা-বড়দিন-বুদ্ধপূর্ণিমাসহ অন্যান্য ধর্মীয় ও সার্বজনীন সামাজিক অনুষ্ঠানগুলো নির্বিঘেœ, অসাম্প্রদায়িক পরিবেশে, কোনো ধরনের ভয়ভীতি এবং পুলিশি পাহারা ব্যতিরেকে অনুষ্ঠিত হবে।
সভায় তিনটি বিষয়ের প্রতি সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। সেগুলো হলোÑদুর্গাপূজা চলাকালে কোনো ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি না দেয়া; দুর্গাপূজাসহ অন্যান্য প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সময় স্কুল, কলেজ, পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিভাগে পরীক্ষা না রাখা; দুর্গাপূজাসহ অন্যান্য প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সময় সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পরীক্ষা না রাখা।
দুর্গাপূজার প্রাক্কালে বিভিন্ন সাংগঠনিক পর্যায়ে বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদের সভা এবং কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদের সভার মতামতের ভিত্তিতে সভা থেকে বিভিন্ন দাবি উত্থাপন করা হয়। সেগুলো হলোÑ১. দুর্গাপূজায় দুই দিনের সরকারি ছুটি ঘোষণা করা। ২. দুর্গাপূজাও জাতীয় মর্যাদায় পালনের পদক্ষেপ নেয়া। ৩. পূজার দিনে কারাগার, হাসপাতাল, অনাথ আশ্রমে উন্নত মানের খাবার পরিবেশন করা। ৪. সরকারি অনুদান পূজা উদ্যাপন পরিষদের স্থানীয় কমিটির তালিকা অনুযায়ী বণ্টন করা। ৫. দেবোত্তর সম্পত্তি পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ আইন প্রণয়নে সাম্প্রতিক সময়ে সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপ দ্রুত বাস্তবায়ন করা। ৬. একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষিত ধর্মীয় সংখ্যালঘু বিশেষ সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন, অর্পিত সম্পত্তি ফেরত প্রদানে প্রশাসনিক জটিলতা নিরসন এবং সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়া এবং দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে দ্রুত বিচারের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করার প্রতিশ্রুতি সরকারের এই মেয়াদে বাস্তবায়ন করা। ৭. হিন্দুধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের পরিবর্তে হিন্দু ফাউন্ডেশন গঠন করা। ৮. প্রতিটি জেলায় একটি করে মডেল মন্দির কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠা করা। ৯. টোলগুলোর সংস্কার ও টোল শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন ধার্য করা। ১০. ২০২১ সালে দুর্গাপূজার সময়ে সংগঠিত সহিংসতাসহ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে দেশব্যাপী হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর, মন্দিরে হামলা, লুটপাট, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাগুলোর তদন্ত ও দ্রুত বিচার করা।