Print Date & Time : 16 June 2025 Monday 9:01 pm

এমপ্লয়াবিলিটি: ক্যারিয়ার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সর্বশেষ দর্শন

এমএ আক্কাস: বিশ্বায়নের এ যুগে অর্থনীতির গতিপ্রকৃতির সঙ্গে গত এক দশকে বদলে গেছে কর্মবাজারের চেহারাও। এখন প্রতিষ্ঠানগুলোর লক্ষ্য মানবসম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন। তাই মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে বিশ্বের সেরা প্রতিষ্ঠানগুলো। মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার আধুনিকতম দর্শন ‘এমপ্লয়াবিলিটি’ (Employability) । জব সিকিউরিটির প্রথাগত ধারণার পরিবর্তে কর্মীর দক্ষতা উন্নয়নের মনোভাবকে প্রাধান্য দেওয়াই এ ধারণার ভিত্তি।

চাকরি পাওয়া ও তা ধরে রাখার দক্ষতাকেই বলা হচ্ছে ‘এমপ্লয়াবিলিটি’। কোনো সন্দেহ নেই, এ যুগের প্রতিযোগিতামূলক কর্মবাজারে দক্ষতা অর্জন করা চ্যালেঞ্জিং। সার্টিফিকেট ও অভিজ্ঞতার বাইরেও ক্রমাগত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা অর্জন করাই এখনকার কর্মবাজারে টিকে থাকার একমাত্র কৌশল। এটি শ্রমসাধ্য ও শিক্ষণীয় প্রক্রিয়া। আত্মোন্নয়নের মাধ্যমে কর্মী নিজেই নিজের চাকরির নিরাপত্তা বিধান করে থাকে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে, এই ধারণা ব্যক্তির কর্মজীবনকে অনিশ্চয়তায় ফেলছে। প্রকৃতপক্ষে তা নয়। সারা জীবন একই কাজে বহাল থেকে পদোন্নতি ঘটাবেন, নাকি কর্মবাজারে নিজের পছন্দমতো চাকরি খুঁজে নেবেন, এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা কর্মী নিজেই অর্জন করবেন। তাই কর্মবাজারের ছুড়ে দেওয়া ‘এমপ্লয়াবিলিটি’র ধারণাটি চ্যালেঞ্জিং হলেও এটিকেই গ্রহণ করেছে আধুনিক তরুণরা।

এমপ্লয়াবিলিটির দর্শন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। জাপানে এখনও জব সিকিউরিটিই প্রধান। এখানে কর্মী নিয়োগে মেধাকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। আজীবন প্রশিক্ষণ গ্রহণের মাধ্যমে ওই কর্মীরা হালনাগাদ থাকেন।

বিশ্ব চাকরি বাজার এখন দ্রুত পরিবর্তনশীল। একটি চাকরির মাধ্যমে সারা জীবন কাটিয়ে দেওয়ার কথা এখনকার তরুণরা কমই চিন্তা করে। অনেক তরুণই ক্যারিয়ারের সোজাসাপ্টা পথ ধরে এগোতে পছন্দ করে না। এক গবেষণায় দেখা গেছে, আমেরিকার কর্মীরা অবসরে যাওয়ার আগপর্যন্ত গড়ে ১১টি চাকরি পরিবর্তন করেন। কেউ কেউ আবার স্বল্প সময়ে পেশাগত সফলতা কামনা করেন। একই চাকরি ধরে রেখে ভাগ্যপরীক্ষা করার ধৈর্য তাদের নেই। মোটের ওপর বলা যায়, কর্মবাজারে কর্মীদের নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দ আগের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব বহন করে।

অন্যপক্ষে অবস্থান করছে কর্মদাতা প্রতিষ্ঠান। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যেসব কর্মী নিজেদের হালনাগাদ করতে ব্যর্থ হয় অথবা উৎপাদন ক্ষমতা কমে আসে, প্রতিষ্ঠান সে কর্মীদের রাখতে চায় না। কর্মীর উদ্যোগ, সৃষ্টিশীলতা ও কর্মদক্ষতা বিবেচনায় কাজের স্থায়িত্ব নির্ধারণ করে প্রতিষ্ঠানগুলো। তাই ‘জব সিকিউরিটি’র ধারণা উন্নত বিশ্বে তো বটেই, আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের চাকরির বাজারেও অকেজো হয়ে পড়ছে দিনকে দিন। সেই স্থান দখল করছে ‘এমপ্লয়াবিলিটি’। এটিই বিশ্বের সর্বশেষ ব্যবস্থাপনা দর্শন।

‘এমপ্লয়াবিলিটি’ তৈরির জন্য কাজের সুযোগ ও পরিবেশ গড়ে তোলার দায়িত্ব প্রতিষ্ঠানের। কর্মীর দক্ষতা বিকাশে সহযোগিতা করবে প্রতিষ্ঠান। এ সুযোগের সর্বোচ্চ ব্যবহার করে নিজের দক্ষতা অর্জনের দায়িত্ব কর্মীর নিজের। ডেনমার্কের ব্যবসাসফল ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি নভো নরডিস্কের মতো ৪০ হাজার কর্মীর বিশ্বসেরা প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে এমপ্লয়াবিলিটি প্রয়োগ করেছে।

আমাদের গ্র্যাজুয়েটরা শিক্ষাজীবন শেষ করে কর্মজীবনে প্রবেশ করে যে প্রথাগত মনস্তত্ত্ব নিয়ে, তা হলো জব সিকিউরিটি অর্থাৎ চাকরির নিরাপত্তা। চাকরি হারিয়ে হতাশার মুখোমুখি হতে চান না কেউ। এজন্যই এখনও এ দেশে সরকারি চাকরি বেশি জনপ্রিয়। বাংলাদেশে সরকারি প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ে জব সিকিউরিটি থাকলেও প্রশিক্ষণের তেমন ব্যবস্থা না থাকায় কর্মীর দক্ষতার হানি ঘটে। জাপান অথবা যুক্তরাষ্ট্র, কোনো দেশেরই মানবসম্পদ দর্শনের বাস্তবায়ন নেই এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে।

আমাদের দেশে বেসরকারি ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোতে ‘এমপ্লয়াবিলিটি’র প্রয়োগ সীমিত পর্যায়ে হলেও গত এক দশক ধরে লক্ষ করা যাচ্ছে। এখানেও চাকরির নিরাপত্তার বিষয়টি প্রতিষ্ঠানের দেওয়া কোনো অঙ্গীকার নয়। বরং কর্মীর দক্ষতাই চাকরিজীবনের নিরাপত্তাকবচ। এই দক্ষতা সময়োপযোগী ও উৎপাদনশীল।

এমপ্লয়মেন্ট সিকিউরিটি অর্থাৎ চাকরির প্রথাগত নিরাপত্তা ধারণার সঙ্গে এমপ্লয়াবিলিটির কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। প্রথমটির নিশ্চয়তা দেয় কোম্পানি। অন্যটিতে কর্মীই নিজের নিরাপত্তার অধিকর্তা। তার দক্ষতাই নিশ্চিত করে চাকরির নিরাপত্তা। চাকরি এখানে অপেক্ষাকৃত কম স্থায়ী। এখানে দক্ষতার উন্নয়নে বেশি জোর দেওয়া হয়। কোম্পানি ও কর্মী দুপক্ষই স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে এর সুফল ভোগ করে।

চাকরি ধরে রাখতে দরকার

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে চাকরির বাজারে এমপ্লয়াবিলিটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গতিশীল অর্থনৈতিক বিশ্বে চাকরি পাওয়া যতটা না কঠিন, ধরে রাখা তার চেয়ে বেশি কঠিন। আজকের বিশ্বে চাকরির নিশ্চয়তা বিধান করে যেসব দক্ষতা, সেগুলো দীর্ঘ মেয়াদে অথবা আজীবন অর্জন করার বিষয়। সর্বপ্রথম চাকরি ধরে রাখার জন্য অবশ্যই আকাক্সক্ষা বা ইচ্ছাশক্তি থাকতে হবে। এজন্য পছন্দের একটি চাকরি বেছে নেওয়া খুবই জরুরি। কেননা পছন্দের কাজই কেবল কর্মীর ভেতরে দক্ষতা বাড়ানোর আকাক্সক্ষা তৈরি করবে।

চাকরিতে টিকে থাকতে কর্মীর আচরণ থেকে কর্মঘণ্টার প্রতিটি পদক্ষেপই হিসাব করা হয়। অফিসপ্রধান, সহকর্মী ও ক্লায়েন্ট বা কাস্টমারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকা পেশাদারিত্বের অংশ।

কোনো প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠার জন্য ওই প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখতে হবে কর্মীকে। প্রতিষ্ঠানকে ভালো করে জানলে কাজের প্রতি যতেœর মনোভাব জš§াবে।

যোগ্য কর্মী হয়ে উঠতে হলে সবসময় ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করা প্রয়োজন। ইতিবাচক মনোভাবই কর্মীকে চ্যালেঞ্জিং কাজের মুখোমুুুুখি করবে। কঠিন সময়গুলোতে সমাধানের পথ বের করতে সহায়তা করবে।

কোম্পানির মুনাফার বিষয়টি কৌশলের সঙ্গে বিবেচনা করবে একজন বুদ্ধিমান কর্মী। স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে প্রতিষ্ঠানের আয় বাড়াতে দরকারি অবদান রাখতে সচেষ্ট থাকতে হবে।

দায়িত্বের বাইরে অতিরিক্ত কাজের ভার নেওয়ার মনোভাব থাকতে হবে। শুধু বাংলাদেশের করপোরেটই নয়, এ যুগে বিশ্বের সব প্রতিষ্ঠানই নির্দিষ্ট মানবসম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে বেশি মুনাফা অর্জন করতে চায়। তাই বহুমুখী কাজের জন্য দক্ষতা অর্জনের মানসিক প্রস্তুতি থাকবে কর্মীর মধ্যে। ‘এটা আমার কাজ নয়’ এ ধরনের মনোভাব আত্মঘাতী হতে পারে।

আধুনিক প্রতিষ্ঠানে করপোরেট সংস্কৃতি খুবই সংবেদনশীল একটি বিষয়। অফিসপ্রধান ও সহকর্মীদের সমালোচনা করার প্রবণতা এড়াতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে।

প্রতিষ্ঠানের কাজগুলোকে নিয়মমাফিক গুছিয়ে করার দক্ষতা অর্জন করতে হবে। কেতাদুরস্ত ও সময় সম্পর্কে সচেতন থাকা অবশ্যই জরুরি। নিজের অবস্থানে যতটা সম্ভব সৃষ্টিশীল হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। কর্মীকে প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্যের ব্যাপারে থাকতে হবে দায়বদ্ধ। পেশাগত ট্রেনিংয়ের ব্যাপারে আগ্রহী থাকা ও কাজকে ভালোবাসা কর্মীর পেশাদারিত্বের প্রকাশ।

প্রতিযোগিতার এই বিশ্বে চাকরির নিশ্চয়তার বিষয়টি কর্মীকেই নিশ্চিত করতে হবে। এ যুগের করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো মানবসম্পদ উন্নয়নে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করে থাকে। এক্ষেত্রে গবেষণাও চলেছে প্রতিনিয়ত। তবে এমপ্লয়াবিলিটি এমন একটি দক্ষতা, যার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আত্মসচেতনতা। এটিকে তাই মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার মনস্তাত্ত্বিক দর্শনও বলা যেতে পারে।

 

লেখক : অধ্যাপক, ম্যানেজমেন্ট, বাণিজ্য অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়