এয়ারক্রাফট অলস বসিয়ে রেখে বিমানের ক্ষতি ২১১ কোটি টাকা

হামিদুর রহমান: এয়ারক্রাফটের যন্ত্রপাতি (পার্টস) সহজলভ্য নয় জানা সত্ত্বেও লিজ গ্রহণ করায় একাধারে ৯ মাস এয়ারক্রাফট অন গোয়িং (এওজি) থাকায় ও ফেরত প্রদানে যন্ত্রাংশ দুষ্প্রাপ্যতার জন্য (রিডেলিভারি) সি-চেকের জন্যও ১৯ মাস বিলম্ব হয়। এতে এয়ারক্রাফট পরিচালনা ব্যতীত লিজ রেন্ট প্রদানে প্রায় ২১১ কোটি ৩০ লাখ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, যা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের কিছু অসাধু কর্মকর্তার পকেট ভারীর অপকৌশল বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।

তারা বলেন, যখন পুরোনো কোনো মডেলের এয়ারক্রাফটের পার্টস সহজলভ্য না জেনেও কোনো ডিপার্টমেন্ট বা ব্যক্তি এসব কাজে আগ্রহ দেখায়, তখন ব্যক্তিগত স্বার্থ থাকে। বিষয়টি নিয়ে গত বছর মামলা দায়ের করে দুর্নীতি দমন কমিশন দুদক। মামলায় অভিযোগে বলা হয়, ‘এসব কর্মকর্তা পরস্পর যোগসাজশ ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রতারণার মাধ্যমে নিজেরা লাভবান হয়ে এবং অন্যকে লাভবান করার অসৎ উদ্দেশ্যে ইজিপ্ট এয়ার থেকে দুটো এয়ারক্রাফট লিজ আনেন। পরে উড়োজাহাজ দুটি ফেরত দেয়া পর্যন্ত তারা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ১ হাজার ১৬১ কোটি টাকার ক্ষতিসাধনপূর্বক আত্মসাৎ করেছেন।’
প্রাপ্ত তথ্যমতে, বিমান বাংলাদেশ এয়রাইলাইনস লি. এবং ইজিপ্ট এয়ার হোল্ডিং কোম্পানির সঙ্গে বোয়িং ৭৭৭-২০০ইআর (এমএসএন: ৩২৬৩০), রেজি: এস২-এএইচএল এবং বোয়িং ৭৭৭-২০০ইআর (এমএসএন: ৩২৬২৯), রেজি: এস২-এএইচকে ব্যবহার করার জন্য ২০১৪ সালের ১১ মার্চ পর্যন্ত ৬০ মাসের চুক্তি হয়।

এই লিজ গ্রহণের ক্ষেত্রে এই এয়ারক্রাফট দুটি ইকোনমিক্যালি ভায়াবল হবে কি না, এ-সংক্রান্ত বিশ্লেষণ-যাচাই করা হয়নি। লিজ গ্রহণের জন্য বিমানের মার্কেটিং অ্যান্ড সেলস বিভাগ কর্তৃক চাহিদাও দেয়া হয়নি। এমনকি এই এয়ারক্রাফটের যন্ত্রাংশও বিশ্বব্যাপী দুষ্প্রাপ্য, সে বিষয়ে অবগত করা সত্ত্বেও এই এয়ারক্রাফট লিজ নেয়া হয়েছে। সেফ, ইফিশিয়েন্ট, এডিকুয়েট ইকোনমিক্যালি এবং যথাযথভাবে বিমান বহরে অপারেট করা যাবে কি না প্রভৃতি বিষয় বিবেচনা না করে লিজ গ্রহণ করার ফলে বোয়িং ৭৭৭-২০০ইআর (এমএসএন: ৩২৬২৯, রেজি: এস২-এএইচকে এয়ারক্রাফট ২০১৬ সালের ১৯ ডিসেম্বর থেকে ২০১৭ সালের ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত মোট ৯ মাস এয়ারক্রাফট অন গোয়িং (এওজি) ছিল। ফলে এই দীর্ঘ সময় অপারেট করা না হলেও এই সময়ের জন্য মাসিক ৫ লাখ ৮৫ হাজার ডলার হিসেবে লিজ রেন্ট প্রদান করা হয়েছে। অর্থাৎ এয়ারক্রাফটি বসিয়ে রেখে ৯ মাসের জন্য সরকারকে দিতে হয়েছে প্রায় ৫২ লাখ ৬৫ হাজার ডলার অথবা ৪৪ কোটি ২২ লাখ টাকা।

বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস লিমিটেডের ২০১৮-১৯ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছরের হিসাব-সম্পর্কিত কার্যক্রমের ওপর সম্প্রতি কমপ্লায়েন্স অডিট রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনে এ অনিয়ম উঠে এসেছে। সূত্র জানায়, এয়ারক্রাফট মেরামতের জন্য যন্ত্রাংশের দুষ্প্রাপ্যতার কারণে বিলম্ব ঘটে। এতে প্রতিটি এয়ারক্রাফটের বিপরীতে মাসিক পাঁচ লাখ ৮৫ হাজার ডলার লিজ রেন্ট প্রদান করতে হয়েছে। এভাবে এয়ারক্রাফট অপারেট না করেই বিমানকে সি-চেক (ফেরত প্রদানকালে) লিজ রেন্ট বাবদ প্রদান করতে হয়েছে প্রায় ১৬৭ কোটি সাত লাখ টাকা, যা বিমানের তথা সরকারের সব মিলে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২১১ কোটি ৩০ লাখ টাকা।

চুক্তি অনুযায়ী, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ইজারাদাতা প্রতিষ্ঠানকে উড়োজাহাজ দুটি ফেরত দেবে। আর ফেরত দেয়ার সময় সি-চেক করার জন্য ভিয়েতনাম এয়ারলাইনস ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে ২০১৮ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি চুক্তি হয়। চুক্তি মোতাবেক এয়ারক্রাফট ২টি ১৩ দিনের মধ্যে রিডেলিভারি (সি-চেক) সম্পন্ন করে ইজিপ্ট এয়ার হোল্ডিং কোম্পানিকে ফেরত প্রদান করার শর্ত ছিল। কিন্তু মেরামতের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশের দুষ্প্রাপ্যতার কারণে ভিয়েতনাম এয়ারলাইনস ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড কর্তৃক ১৩ দিনের পরিবর্তে এস২-এএইচএলের জন্য ১৫ মাস এবং এস২-এএইচকের জন্য ১৯ মাস অতিরিক্ত সময় নিয়ে এয়ারক্রাফট দুটির রিডেলিভারি সম্পন্ন করা হয়। চুক্তি মোতাবেক বিলম্বিত সময়ের প্রতি দিনের জন্য ১০ হাজার ডলার পূর্বনির্ধারিত ক্ষতি আরোপ করার বিধান থাকলেও মেরামতের যন্ত্রাংশের দুষ্প্রাপ্যতার কারণে তা আরোপ করা হয়নি। অন্যদিকে, এই বিলম্বিত সময়ের জন্য প্রতিদিন এয়ারক্রাফটের বিপরীতে মাসিক ৫ লাখ ৮৫ হাজার ইউএস ডলার লিট রেন্ট প্রদান করতে হবে। এভাবে এয়ারক্রাফট অপারেট না করেই বিমানকে সি-চেক (ফেরত প্রদানকালে) প্রাক্কালে লিজ রেন্ট বাবদ প্রদান করতে হয়েছে ১৬৭ কোটি ৭ লাখ ৬০ হাজার টাকা; যা বিমানের তথা সরকারের আর্থিক ক্ষতি হিসেবে গণ্য। ফলে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের মোট ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২১১ কোটি ৩০ লাখ টাকা।

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের মেমোরেন্ডাম অ্যান্ড অ্যারোটিক্যাল অব অ্যাসোসিয়েশনের অনুচ্ছেদ-২ মতে, ‘টু প্রোভাইড অ্যান্ড ডেভেলপ সেফ, ইফিসেন্ট, এডিক্যুয়েট, ইকোনমিকেল অ্যান্ড প্রোপারলি কোর্ডিনেটেড এয়ার ট্রান্সপোর্ট সার্ভিসেস’ এবং অনুচ্ছেদ-৪ অনুযায়ী কমার্শিয়াল অবলিগেশন বা বাণিজ্যিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অর্থাৎ লিজ গ্রহণের বিষয়টি বাণিজ্যিকভাবে সফল হবে কি না; তা বিবেচনায় নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে উড়োজাহাজ লিজ গ্রহণের ক্ষেত্রে কমার্শিয়াল অবলিগেশন বা বাণিজ্যিক বাধ্যবাধকতা এবং ‘টু প্রোভাইড অ্যান্ড ডেভেলপ সেফ, ইফিসিয়েন্ট, এডিক্যুয়েট, ইকোনমিকেল অ্যান্ড প্রপারলি কোরডিনেটেড এয়ার ট্রান্সপোর্ট সার্ভিসেস’ বিষয়টি বিবেচনা না করে যে উড়োজাহাজ স্পেয়ার পার্টস বিশ্ব বাজারে তৈরি হয় না সেই উড়োজাহাজ লিজ নেয়া হয়েছে অর্থাৎ অদক্ষতার পরিচয় দেয়া হয়েছে। ফলে কোম্পানির মেমোরেন্ডাম অ্যান্ড আরটিক্যাল অব অ্যাসোসিয়েশনের অনুচ্ছেদ-২ ও ৪ লঙ্ঘিত হয়েছে।
জানতে চাইলে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের জনসংযোগ কর্মকর্তা বোশরা ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘বিষয়টি আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। যেহেতু আদালতে মামলা হয়েছে সুতরাং আদালতের রায় না হওয়া পর্যন্ত এ বিষয়ে মন্তব্য করতে চাই না।’

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০