Print Date & Time : 16 June 2025 Monday 10:08 pm

এলএনজি ও গ্যাস খাতে ভর্তুকি নিয়ে ধোঁয়াশা

নিজস্ব প্রতিবেদক: গ্যাসের চাহিদা মেটাতে ২০১৮ সালের আগস্ট থেকে এলএনজি আমদানি শুরু করেছে বাংলাদেশ। উচ্চ মূল্যের এ তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানিতে প্রতি বছর বড় অঙ্কের ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার। আবার গ্রাহক পর্যায়ে সরবরাহকৃত গ্যাসের দামেও দেয়া হচ্ছে ভর্তুকি। তবে কোন খাতে কত ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে তা নিয়ে তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা।

গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবের ওপর চলমান গণশুনানিতে এ বিষয়ে সঠিক তথ্য দেয়া হয়নি। বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। এক্ষেত্রে ভর্তুকির সঠিক হিসাব তুলে ধরে গ্যাসের মূল্য নির্ধারণের সুপারিশ করে ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা এ সংগঠনটি।

শুনানিতে এলএনজি আমদানি ও গ্রাহক পর্যায়ে সরবরাহে লোকসান দেখিয়ে গ্যাসের দাম ১১৭ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়। তবে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কারিগরি কমিটি দেখায়, এলএনজি আমদানির ভর্তুকির পুরোটার ব্যবহার হচ্ছে না। এতে গত তিন অর্থবছর পেট্রোবাংলার কাছে এলএনজি আমদানি বাবদ সাশ্রয় হয়েছে প্রায় দুই হাজার ৫৩৮ কোটি টাকা।

তথ্যমতে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এলএনজি আমদানিতে মোট ব্যয় হয় ১১ হাজার ৮৪২ কোটি ৩০ লাখ টাকা। আর এলএনজি বিক্রি থেকে আয় হয় সাত হাজার ৬৬১ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। এছাড়া সরকার ভর্তুকি দেয় দুই হাজার ৫০০ কোটি টাকা। সে বছর পেট্রোবাংলার ঘাটতি ছিল এক হাজার ৬৮০ কোটি ৩৬ লাখ টাকা।

২০১৯-২০ অর্থবছরে এলএনজি আমদানিতে মোট ব্যয় হয় ১৮ হাজার ১৫০ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। এলএনজি বিক্রি থেকে পেট্রোবাংলার আয় হয় ১৬ হাজার ৪৬১ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। আর সরকার ভর্তুকি দেয় তিন হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এতে পেট্রোবাংলার উদ্বৃত্ত থাকে এক হাজার ৮১১ কোটি আট লাখ টাকা।

এদিকে ২০২০-২১ অর্থবছরে এলএনজি আমদানিতে মোট ব্যয় হয় ১৭ হাজার ২২২ কোটি দুই লাখ টাকা। আর এলএনজি বিক্রি থেকে পেট্রোবাংলার আয় হয় ১৭ হাজার ২২৯ কোটি ২১ লাখ টাকা। সরকার ভর্তুকি দেয় দুই হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এতে পেট্রোবাংলার উদ্বৃত্ত থাকে দুই হাজার ৪০৭ কোটি ১৯ লাখ টাকা। এতে গত অর্থবছর শেষে প্রথম বছরের ঘাটতি মিটিয়েও পেট্রোবাংলার কাছে জমা ছিল দুই হাজার ৫৩৭ কোটি ৯১ লাখ টাকা। তবে এ অর্থ কোথায় ও কীভাবে আছে তা শুনানিতে পরিষ্কার জানায়নি পেট্রোবাংলা। এমনকি ক্যাবের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে তথ্য চাওয়া হলেও তা জানানো হয়নি।

এ বিষয়ে ২০ মার্চ অনুষ্ঠিত শুনানিতে ক্যাবের জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা ও সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, তাদের কাছে যে তথ্য চেয়েছিলাম তার কোনো তথ্যই পাওয়া যায়নি। এমন অবস্থায় গণশুনানিতে অংশ নেয়া কোনো অর্থ বহন করে না। তাদের তথ্য না দেয়ার কি মিনিং থাকতে পারে!

এমনকি গ্যাসের দাম বৃদ্ধির আবেদন করলেও বিইআরসিকে সুষ্ঠু তথ্য দেয়নি পেট্রোবাংলা। গণশুনানির জন্য গত জানুয়ারিতে দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব জমা দেয় সংস্থাটি। তবে সে প্রস্তাব অসম্পূর্ণ উল্লেখ করে একাধিকবার চিঠি দেয় বিইআরসি। তবে তারা পূর্ণাঙ্গ তথ্য জমা দেয়নি।

এদিকে গতকাল শুনানিতে জানানো হয়, ২০১৯ সালের ১ জুলাই সর্বশেষ বাড়ানো হয়েছিল গ্যাসের দাম। সে সময় প্রতি ইউনিটে দুই টাকা ৮৯ পয়সা হারে ভর্তুকি দেয়ার কথা ছিল সরকারের। সে হিসাবে চলতি অর্থবছর সাত হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়ার কথা রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত দেয়া হয়েছে মাত্র তিন হাজার কোটি টাকা। বাকি টাকা দেয়া হবে না ধরেই গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাসের দাম নির্ধারণের সুপারিশ করে বিইআরসির কারিগরি কমিটি।

শুনানিতে কারিগরি কমিটি এ বিষয়ে জানায়, চলতি (২০২১-২২) অর্থবছর গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাস সরবরাহের সম্ভাব্য পরিমাণ দাঁড়াবে তিন হাজার ৮৬ কোটি ৫৮ লাখ ঘনমিটার। এজন্য ব্যয় হবে প্রায় ৪৯ হাজার ১২৭ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এতে ইউনিটপ্রতি ব্যয় পড়বে ১৫ টাকা ৯২ পয়সা। আর গ্রাহকদের কাছে গ্যাস বিক্রি করে পাওয়া যাবে ৩৫ হাজার ৯২৭ কোটি ৭০ লাখ টাকা। বাকি ১৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা ঘাটতি থাকবে।

এ ঘাটতি মেটাতে জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিল (ইএফএস) থেকে দেয়া হবে চার হাজার কোটি টাকা। আর গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর অবণ্টিত মুনাফা থেকে ছয় হাজার ২০০ কোটি টাকা দেয়া হবে। গত জুন পর্যন্ত কোম্পানিগুলোর এ মুনাফার পরিমাণ ছিল ১২ হাজার ৪৩৬ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছর শেষে তা বেড়ে ১৪ হাজার ৩৯৪ কোটি ৭১ লাখ টাকায় পৌঁছাতে পারে। আর সরকার ভর্তুকি দেবে তিন হাজার কোটি টাকা।

ভর্তুকি, অনুদান ও ইএফএস বাদ দেয়ার পর ভোক্তা পর্যায়ে গ্যাসের দাম পড়বে ১১ টাকা ৬৪ পয়সা। আর বর্তমানে গ্যাসের মূল্যহার ৯ টাকা ৭০ পয়সা। এতে ঘাটতি থাকে এক টাকা ৯৪ পয়সা। এ ঘাটতি মেটাতে গড়ে ২০ শতাংশ হারে মূল্য বৃদ্ধি করতে হবে।

শুনানিতে এ নিয়েও আপত্তি তোলেন অধ্যাপক শামসুল আলম। তিনি বলেন, বিইআরসির গতবারের মূল্যহার আদেশ অনুযায়ী সরকার প্রতি ইউনিটে দুই টাকা ৮৯ পয়সা হারে ভর্তুকি দেয়ার কথা ছিল। তাই গ্যাসের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে ভর্তুকির ওই হারকেই বিবেচনা করতে হবে। যদি সরকার তা দিতে অস্বীকৃতি জানায় তাহলে কমিশনের আদেশ অমান্য করার দায়ে বিইআরসি আইনে সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে। কিন্তু তা না করে কারিগরি কমিটি ইচ্ছেমতো ভর্তুকি কমিয়ে মূল্য বৃদ্ধির সুপারিশ করেছে। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আর সরকার যে তিন হাজার কোটি টাকার বেশি ভর্তুকি দেবে না তা কমিশনকে লিখিতভাবে জানায়নি। তাই আগেই গ্যাস খাতে সরকার কত ভর্তুকি দেবে তা নির্ধারণ করার কোনো সুযোগ নেই। বিষয়টি নিয়ে ধোঁয়াশা দূর করা দরকার।