নিজস্ব প্রতিবেদক: ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা (এলডিসি) থেকে উত্তরণ ঘটবে বাংলাদেশের। এ উত্তরণের পর বাংলাদেশ কোন পথে অগ্রসর হবে, সে বিষয়ে এখন থেকেই প্রস্তুতি নেয়া আবশ্যক। কেননা উত্তরণের পর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে নানা ধরনের সহায়তা হারাবে বাংলাদেশ। বিশেষ করে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) সদস্য হিসেবে ২০২৬ সালের পর থেকে বাংলাদেশকে বেশকিছু বিধিনিষেধ মেনে চলতে হবে। কিন্তু এলডিসি হিসেবে ডব্লিউটিওর কাঠামোর অধীনে বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল সাপোর্ট মেজারসের (আইএসএম) আওতায় বর্তমানে যেসব সুবিধা পায়, সেগুলো বহাল রাখা বা একটি উত্তরণকালীন এলডিসি দেশ হিসেবে সেখান থেকে বাংলাদেশ তেমন সুবিধা পাবে না। এজন্য নতুন নতুন রপ্তানি গন্তব্যের অনুসন্ধান করতে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর ও পণ্যের বহুমুখীকরণ আবশ্যক। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে বাংলাদেশের অগ্রগতির বিষয়ে রাজনৈতিক ও কারিগরি বর্ণনার মধ্যে একটি সামঞ্জস্য থাকা আবশ্যক।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) আয়োজিত এক সেমিনারে গতকাল বক্তারা এ কথা বলেন। গত জুন মাসে অনুষ্ঠিত ডব্লিউটিওর ১২তম মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে (এমসি-১২) এলডিসিভুক্ত দেশগুলোর জন্য প্রাপ্তি কী ছিল সে বিষয়ে আলোকপাত করার জন্য ‘ডব্লিউটিও-এমসি ১২ আউটকামস: নেকস্ট স্টেপস ফর বাংলাদেশ অ্যাজ এ গ্র্যাজুয়েটিং এলডিসি’ শীর্ষক এ সেমিনার আয়োজন করা হয় রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে।
সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের সভাপতিত্বে সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় সংসদের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন, বিশেষ অতিথি ছিলেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব তপন কান্তি ঘোষ, সম্মানিত অতিথি ছিলেন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান।
আলোচনায় অংশ নিয়ে তপন কান্তি ঘোষ বলেন, ‘এবারের মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য আশাবাদী হওয়ার মতো কোনো আলোচনা হয়নি। সম্মেলনে যে প্রক্রিয়ায় আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে, সেখানে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর কোনো ভূমিকাই ছিল না। বিশেষ করে চূড়ান্ত পর্যায়ের আলোচনায় এলডিসিগুলোকে একপ্রকার উপেক্ষা করা হয়েছে। এ ধরনের আচরণে আমরা যারপরনাই হতাশ। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের উপলব্ধি হলো, এলডিসি থেকে উত্তরণের ক্ষেত্রে ডব্লিউটিওর
মাধ্যমে তেমন সুবিধা পাওয়া যাবে না, যা কিছু করার আমাদের নিজেদেরই করতে হবে।’
তিনি বলেন, একটি উত্তরণকালীন এলডিসি দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে এখন থেকেই পণ্যের বহুমুখীকরণ ও নতুন নতুন বাজার অনুসন্ধান করতে হবে। আর এলডিসি থেকে উত্তরণের পর
বাংলাদেশ ইউরোপের বাজারে অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা হারাবে। ফলে রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এমন পরিস্থিতিতে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) ও অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) স্বাক্ষরের মাধ্যমে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বাড়িয়ে এলডিসি থেকে উত্তরণ-পরবর্তী ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার উদ্যোগ নিতে হবে।
তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ হয়নি। ৮৩ শতাংশ রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাকশিল্পের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু আরও যদি চার-পাঁচটি খাত তৈরি পোশাকের কাছাকাছি অবস্থানে থাকত, তাহলে উত্তরণ-পরবর্তী ঝুঁকি মোকাবিলা করা সহজ হতো। পণ্যের বহুমুখীকরণের ওপর জোর দিয়ে তিনি তৈরি পোশাক খাতেও মনুষ্যসৃষ্ট ফাইবারের ব্যবহার বৃদ্ধিসহ নতুন নতুন পণ্য উদ্ভাবনের ওপর জোর দেন।
ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন বলেন, ‘এলডিসি থেকে উত্তরণের পর বাংলাদেশ ইউরোপের বাজারে জিএসপি সুবিধা হারাবে। কিন্তু সে সময় জিএসপি প্লাস সুবিধা পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে সে সুযোগ পাওয়ার জন্য নানা ধরনের সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। এখন থেকেই সেই পদক্ষেপ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে।’ বাণিজ্য সংগঠনগুলোর গবেষণা কার্যক্রমে জোর দেয়া উচিত বলে উল্লেখ করেন তিনি। পামাপাশি কোনো নির্দিষ্ট পণ্য বা সেবার ওপর কর আরোপের ক্ষেত্রে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড যাতে বাস্তব অবস্থা পর্যালোচনা করে পদক্ষেপ নেয়, সে বিষয়ে জোর দেন তিনি।
মূল প্রবন্ধে অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এর আগে ছয়টি দেশ এলডিসি থেকে উত্তরণ করলেও সেগুলো বৈশ্বিক অর্থনীতিতে তেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে না। কাজেই বৃহৎ কোনো এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশই প্রথম উত্তরণ করতে যাচ্ছে। ফলে বাংলাদেশকে অনেক বুঝেশুনে পা ফেলতে হবে। তিনি উল্লেখ করেন, উত্তরণকালীন বা গ্র্যাজুয়েটিং এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশ ও অন্যান্য দেশ কিছু সুবিধার প্রস্তাব দিয়েছিল এবারের সম্মেলনে। তবে ডব্লিউটিওর কাঠামোর মধ্যে গ্র্যাজুয়েটিং এলডিসি হিসেবে কোনো ক্যাটেগরি নেই। কাজেই নির্দিষ্ট কাঠামোর আওতায় সুবিধা দাবি করতে হবে। তাছাড়া উত্তরণকালীন ও উত্তরণের পরে বাংলাদেশসহ অন্যান্য এলডিসি দেশগুলো অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা অব্যাহত রাখার দাবি করলেও সে সুবিধা কতদিন বহাল রাখা উচিত, সে বিষয়ে প্রস্তাবে কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা উল্লেখ ছিল না। ফলে এ প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য হয়নি। তবে এলডিসি থেকে উত্তরণের পরও ডব্লিউটিওর কাঠামোর মধ্যে কিছু সুবিধা পাওয়ার সুযোগ রয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি উল্লেখ করেন, ২০২৬ সালের পর বাংলাদেশ যেহেতু এলডিসি থেকে বেরিয়ে যাবে, কাজেই এখন থেকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের বিষয়ে বাংলাদেশ যেসব নীতি প্রণয়ন করবে, সেগুলো যেন একটি উন্নয়নশীল দেশের নীতিমালার মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, সে বিষয়টি এখন থেকেই নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বাড়ানোর জন্য ডব্লিউটিও সেলের আদলে একটি নেগোসিয়েশন সেল গঠনের প্রস্তাব দেন তিনি।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডব্লিউটিও সেলের মহাপরিচালক হাফিজুর রহমান বলেন, ডব্লিউটিও থেকে আমাদের খুব বেশি প্রত্যাশা করা ঠিক হবে না। এবারের মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনে আমাদের তেমন উপলব্ধি হয়েছে। এবারের সম্মেলনে যে ১০টি ঘোষণা এসেছে, তার মধ্যে চারটিই কভিড-পরবর্তী অর্থনীতি পুনরুদ্ধার-সংক্রান্ত। সেখানে এলডিসিভুক্ত দেশগুলো নিয়ে তেমন কোনো আলোচনাই ছিল না। বিষয়টি আমাদের জন্য হতাশাব্যঞ্জক। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে স্ব-উদ্যোগে এগিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে।
জসিম উদ্দিন বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এলডিসিভুক্ত দেশগুলোর চ্যালেঞ্জ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এর ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতির কারণে দেশে নতুন স্থানীয় ও বৈদেশিক বিনিয়োগ বিঘ্নিত হচ্ছে। এলডিসি থেকে উত্তরণ-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য তিনি রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ, দক্ষতার উন্নয়ন, শুল্ক যৌক্তিকীকরণ ও জিএসপি প্লাস সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে দরকষাকষির সক্ষমতা বাড়ানোর ওপর জোর দেন।
সমাপনী বক্তব্যে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ডব্লিউটিও থেকে প্রাপ্তি নিয়ে হতাশা থাকলেও সংস্থাটিকে সংকীর্ণভাবে দেখা ঠিক হবে না। তিনি বলেন, করোনাকালীন দুর্যোগ সত্ত্বেও ডব্লিউটিও একটি মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন করেছে এবং সেখানে অন্তত ১০ দফা ঘোষণা এসেছে। এই ঘোষণা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে বেশ জোরালো ভূমিকা রেখেছে। তিনি উল্লেখ করেন, ১২তম মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনকে কেবল এলডিসিভুক্ত দেশগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে না দেখে সামগ্রিক বৈশ্বিক পরিস্থিতির বিচারে মূল্যায়ন করতে হবে। এলডিসিভুক্ত দেশগুলোর প্রত্যাশা পূর্ণ মাত্রায় পূরণ করতে না পারলেও সংস্থাটি খাদ্য নিরাপত্তা, বিভিন্ন ধরনের নীতি সংস্কার প্রভৃতি বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পেরেছে।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের যেসব রাজনৈতিক প্রতিনিধি অংশ নেন, তারা দেশের নানা ধরনের অর্জন সেখানে তুলে ধরেন। ফলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মনে করে, বাংলাদেশ অনেক উন্নতি করেছে। সুতরাং তাদের আর অগ্রাধিকারমূলক সুবিধা প্রয়োজন নেই। কিন্তু বিভিন্ন কারিগরি অধিবেশনে নানা ক্ষেত্রে সহায়তা চাওয়া হয়। এতে করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিভ্রান্ত হয়। এক্ষেত্রে কোন বয়ানটি সঠিক, তা নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা দেয়। এই ভ্রান্তি দূর করার জন্য রাজনৈতিক বয়ান ও কারিগরি বয়ানের মধ্যে সামঞ্জস্য আনা দরকার বলে তিনি উল্লেখ করেন।
একই সঙ্গে দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলোর মধ্যে ভিন্নতা দূর করে একটি একক পরিকল্পনা দলিলের মধ্যে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দেন তিনি। তিনি উল্লেখ করেন, বর্তমানে তিনটি বিষয় আমাদের পরিকল্পনায় গুরুত্ব পাচ্ছে। এগুলো হলোÑএলডিসি থেকে উত্তরণ, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জন ও কভিডের অভিঘাত থেকে পুনরুদ্ধার। জাতীয় পরিকল্পনা দলিল অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বা অন্য কোনো পরিকল্পনা দলিলে এগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করা হলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আমাদের একটি পরিকল্পনা দলিল দেখেই সব অগ্রাধিকার ও উদ্যোগগুলো সম্পর্কে ধারণা পেতে পারেন। এ বিষয়ে নজর দেয়া জরুরি।