Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 9:26 pm

এলসির প্রভাবে কমেছে বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধি

রোহান রাজিব: ব্যাংকের ঋণপত্র (এলসি) খোলা কমেছে। সঙ্গে তারল্য ও আমানতের প্রবৃদ্ধি কমেছে। এর প্রভাব পড়েছে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধিতে। টানা দুই মাস ধরে এ খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমেছে। অক্টোবরে প্রবৃদ্ধি ১৩ দশমিক ৯১ শতাংশে নেমে এসেছে। গত সেপ্টেম্বর মাসে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ। আর দুই মাসে আগে আগস্টে এ প্রবৃদ্ধি ছিল ১৪ দশমিক শূন্য সাত শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ডলার সংকটের কারণে ঋণপত্র (এলসি) খোলা কমে গেছে। এর প্রভাবে পণ্য আমদানি কমেছে। এজন্য ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়েছেন। তাই তারা এখন আগের মতো ঋণ নিচ্ছেন না। এর ফলে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমেছে। এছাড়া ব্যাংকের তারল্য কমা ও আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার একটা প্রভাব পড়েছে।

কভিড-পরবর্তী সময়ে দেশের আমদানির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলো ঋণের পরিমাণ বেড়ে যায়। এছাড়া ডলারের দাম বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে অতিরিক্ত মূল্য খরচ করতে হওয়ায় ঋণের প্রবৃদ্ধি বেড়ে ছিল। তবে সেপ্টেম্বরে ও অক্টোবর মাসে আমদানি পরিমাণ কমেছে। লোডশেডিং ও জ্বালানি সংকটের কারনে উৎপাদন ক্ষমতা কমেছে। তাই বিনিয়োগের জন্য বেসরকারি ঋণের খুব একটা দরকার পরে না। এজন্য আগের মাসের তুলনায় এ খাতের প্রবৃদ্ধি কমেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের অক্টোবরের মাসের তুলনায় চলতি বছরের অক্টোবরে বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা ব্যাংক খাত থেকে ১৩ দশমিক ৯১ শতাংশ বেশি ঋণ নিয়েছেন। আগের মাস সেপ্টেম্বরে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে বেশি নিয়েছিলেন ১৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবর মাসে বেসরকারি খাতে বকেয়া ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ৮৯ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা। যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ১২ লাখ ১৯ হাজার ৫৩৬ কোটি টাকা। আর চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে ছিল ১৩ লাখ ৭৯ হাজার ৪১৩ কোটি টাকা।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেসরকারি একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেয়ার বিজকে বলেন, বেসরকারি খাতের ঋণের একটা বিরাট অংশ আমদানির সঙ্গে জড়িত। আমদানি কমার কারণে এ খাতের গ্রোথ কমেছে। এছাড়া ব্যাংকগুলো আমানত সংগ্রহে একটা চাপে রয়েছে। তাই সবাই ঋণ কন্ট্রোলে আনার চেষ্টা করছে। এজন্য ঋণ দেয়া কমিয়ে দিচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২২-২৩ অর্থবছরের যে মুদ্রানীতি মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে, তাতে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ। গত ২০২১-২২ অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ। গত অর্থবছর ১৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে শেষ হয়। আগস্টে বেসরকারি খাতের ঋণের যে প্রবৃদ্ধি ছিল তা প্রায় নতুন মুদ্রানীতির লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি ছিল। তবে হঠাৎ করেই সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে সে প্রবৃদ্ধি ছন্দপতন দেখা দিয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, আগের তুলনায় আমদানির পরিমাণ কমেছে। লোডশেডিং ও জ্বালানি সংকটের কারণে উৎপাদন ক্ষমতা কমেছে। তাই বিনিয়োগের জন্য বেসরকারি খাতে ঋণের খুব একটা দরকার পরে না। এ কারণে ধারাবাহিকভাবে এ খাতের প্রবৃদ্ধি কমেছে। এর আগে এ খাতে গ্রোথ হওয়ার কারণ ছিল ডলারের রেট বেশি ছিল। তাই আমদানির ব্যয় টাকার অঙ্কে বেড়েছে। তাই বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধি বেড়েছে।

নতুন আমদানির এলসি খোলা প্রায় অর্ধেকে নামিয়ে আনার তথ্য দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকও। চলতি বছরের মার্চে দেশের ব্যাংকগুলোয় এলসি খোলা হয়েছিল ৯৮০ কোটি ডলারের। অক্টোবরে নতুন এলসি খোলার পরিমাণ ৪৭৪ কোটি ডলারে নামিয়ে আনা হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৮ শতাংশ কম। গত সেপ্টেম্বরেও ৮ বিলিয়ন ডলারের ঋণপত্র খোলা হয়েছিল। সেই হিসাবে এক মাসের ব্যবধানে ঋণপত্র খোলা প্রায় অর্ধেক কমে গেছে।

এদিকে চলতি মাসের ১ থেকে ১৬ নভেম্বর ঋণপত্র খোলা হয়েছে ১ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলারের, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৬৩ শতাংশ কম। গত জুলাই থেকে ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত সব মিলিয়ে ঋণপত্র খোলা হয়েছে ১৯ দশমিক ৫৭ শতাংশ বিলিয়ন ডলারের। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় যা ৩০ শতাংশ কম। তবে ঋণপত্র খোলা কমলেও ঋণপত্র নিষ্পত্তির পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৫ শতাংশ। মূলত আমদানি কমাতে শতভাগ এলসি মার্জিন নির্ধারণের পাশাপাশি এলসি খোলার আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনাপত্তি নিতে হচ্ছে। এছাড়া ব্যাংকগুলোর অপারগতার কারণে আমদানির এলসি প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। এছাড়া গত অর্থবছরে রপ্তানির তুলনায় আমদানি বেশি হওয়ায় সর্বোচ্চ বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছে। বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছে ৩৩.২৫ বিলিয়ন ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ব্যাংকের আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ দশমিক ৯৮ শতাংশ। তা সেপ্টেম্বরে কমে ৭ দশমিক ৭৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া ব্যাংক খাতে তারল্য কমার একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। চলতি বছরের জুন শেষে উদ্বৃত্ত তারল্য ছিল ২ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকা। সর্বশেষ তথ্য দেখা যায়, বর্তমানে ব্যাংক খাতে উদ্বৃত্ত তারল্য রয়েছে ১ লাখ ৬৯ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০২২ সালের প্রথম মাস জানুয়ারিতে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি ১১ শতাংশ ছাড়িয়ে ১১ দশমিক ০৭ শতাংশে উঠেছিল। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় ফেব্রুয়ারিতে এ প্রবৃদ্ধি কমে ১০ দশমিক ৭২ শতাংশে নেমে আসে। মার্চে তা দশমিক ৫৭ শতাংশ পয়েন্ট বেড়ে ১১ দশমিক ২৯ শতাংশে ওঠে। এপ্রিল মাসে তা ১২ শতাংশ ছাড়িয়ে ১২ দশমিক ৪৮ শতাংশে ওঠে। মে মাসে তা আরও বেড়ে ১২ দশমিক ৯৪ শতাংশ ওঠে। জুন মাসে ১৩ শতাংশ ছাড়িয়ে ১৩ দশমিক ৬৬ শতাংশে ওঠে। জুলাই মাসে ১৩ দশমিক ৯৫ শতাংশে ওঠে। আগস্টে বেড়ে ১৪.০৭ শতাংশ ছাড়িয়েছে। সেপ্টেম্বরে কমে ১৩ দশমিক ৯৩ শতাংশে নেমেছে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর শেয়ার বিজকে বলেন, ব্যাংকের তারল্য কমা ও আমানতের গ্রোথ কমে যাওয়ার কারণে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধিতে একটা প্রভাব পড়েছে। আমানত গ্রোথ না হওয়ার অন্যতম কারণÑব্যালেন্স অব পেমেন্টে ঘাটতি ও রিজার্ভের ধারাবাহিক পতন। এছাড়া ব্যাংকের ওপর মানুষের একটা আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। তাই আমানত কমেছে। আর এর প্রভাব গিয়ে পড়ছে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধিতে। তিনি আরও বলেন, ব্যাংকিং সেক্টরে গ্রাহকের আস্থা নষ্ট হলে আমানতের গ্রোথ আরও কমে যাবে। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকে এটা নিয়ে এখনই ভাবতে হবে। প্রয়োজনে ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা করতে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। যাতে কোনো গ্রাহককে টাকা নিতে এসে ফিরে না যেতে হয়।