Print Date & Time : 18 June 2025 Wednesday 7:46 pm

এলসি খুলতে ব্যাংকের দ্বারে দ্বারে আমদানিকারকরা

সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: দেশের ব্যাংকিং খাতে কয়েক মাস ধরে ডলার সংকট চলছে। এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানিপত্র খোলার (এলসি) ক্ষেত্রে কঠোর নীতি অবলম্বন করছে। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক পণ্যের সঠিক দাম যাচাইয়ে কঠোর হচ্ছে। এতে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জসহ বিভিন্ন পর্যায়ের আমদানিকারকদের ভোগান্তির কারণে এলসি খোলার হার আগের মাসের তুলনায় ৫০ শতাংশের বেশি কমেছে। ডলার সংকটের কারণে কোনো কোনো ব্যাংক সরাসরি এলসি নিচ্ছে না। এ কারণে বেশিরভাগ গ্রাহক এলসির জন্য এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে ঘুরছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান মতে, চলতি বছরের জুলাই থেকে এলসি খোলা ও নিষ্পত্তির পরিমাণ কমতে শুরু করে। গত জুনে এলসি খোলার পরিমাণ ছিল ৮৪৪ কোটি ডলার, জুলাইয়ে তা ৬৩৫ কোটি ডলারে নামে। আগস্টে এলসি খোলার পরিমাণ আরও কমে দাঁড়ায় ৬৩৩ কোটি ডলারে। সর্বশেষ সেপ্টেম্বরে আরও কমে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৭০ কোটি ডলারে। এক মাসের ব্যবধানে প্রায় ১০ শতাংশ কমেছে এলসি খোলার হার।

অন্যদিকে জুলাইয়ে দেশে মোট আমদানি ঋণপত্র খোলা হয়েছে ৫৪৭ কোটি ডলার পণ্যের, যা জুনের তুলনায় ৩১ দশমিক ৩২ শতাংশ কম। এদিকে অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে পেট্রোলিয়াম জাতীয় পণ্য আমদানি বেড়েছে ৫০ দশমিক ৯৯ শতাংশ। ভোগ্যপণ্য আমদানি বেড়েছে ৪ দশমিক ৫৬ শতাংশ। একইভাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম ৩ মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি খোলা ব্যাপকভাবে কমেছে।

চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে ৬০ কোটি ৬৮ লাখ ডলারের এলসি খুলেছেন উৎপাদক ও ব্যবসায়ীরা; যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৬৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ কম। গত অর্থবছরের একই সময়ে ১৭৭ কোটি ডলারের মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি করা হয়েছিল।

এদিকে শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে এলসি খোলার হার কমেছে ১৪ দশমিক ৫৭ শতাংশ। এছাড়া মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি কমেছে ১৪ দশমিক ৫৬ শতাংশ। এই ৩ ধরনের পণ্যকে নতুন বিনিয়োগের অন্যতম নিয়ামক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তাই এসব পণ্যের আমদানি কমাকে ভবিষ্যৎ বিনিয়োগের জন্য বাধা হিসেবে দেখা হচ্ছে। এছাড়া বর্তমান অর্থনৈতিক নানা চাপের মধ্যে কেউ নতুন উৎপাদনে যাচ্ছেন না। এজন্যই মূলধনি যন্ত্রপাতিসহ শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশে আমদানি কমলেও ডলার সংকট সহসা কাটছে না। এ অবস্থায় বাজারে সংকট কাটাতে ডলার বিক্রিও বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সব মিলিয়ে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত প্রায় ৫০৮ কোটি ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত অর্থবছরের পুরো সময়ে বিক্রির পরিমাণ ছিল ৭৬২ কোটি ১৭ লাখ ডলার।

ব্যাংক কর্মকর্তারা জানান, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে এলসি খোলা ৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ কমলেও আমদানির দায় পরিশোধ বেড়েছে ১১ দশমিক ৭০ শতাংশ। মূলত সাম্প্রতিক সময়ে আমদানি নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে নতুন এলসি কমছে। যদিও বাকি বা দেরিতে পরিশোধের শর্তে আগে খোলা এলসির দায় পরিশোধ বেড়েছে, যে কারণে বৈদেশিক মুদ্রার খরচ কমেনি। কারণ এলসি খোলার সঙ্গে সঙ্গে কোনো পণ্য আমদানি হয় না। বেশিরভাগ এলসির দেনা পরিশোধ হয় পণ্য দেশে আসার পর। অবশ্য সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বেশিরভাগ আমদানি হচ্ছে বায়ার্স ক্রেডিট বা ডেফার্ড পেমেন্টের মাধ্যমে। এ উপায়ে পণ্য পাওয়ার পর নির্ধারিত সময় শেষে এলসির দায় পরিশোধ করতে হয়।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বেসরকারি ব্যাংকের চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান শেয়ার বিজকে বলেন, আমদানি কমাতে শতভাগ এলসি মার্জিন নির্ধারণের পাশাপাশি এলসি খোলার আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনাপত্তি নিতে হচ্ছে। সব ঠিক থাকার পরও কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক বলে দিচ্ছে, এই এলসি খোলা যাবে না। বিশেষ করে গাড়ি, টিভি, ফ্রিজ, ফুল, ফলের মতো পণ্য আমদানিতে অনেক ক্ষেত্রে অনাপত্তি দিচ্ছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এটা ইতিবাচক। কেননা, এ ধরনের পণ্যের এলসি দায় পরিশোধও করতে হয় দ্রুততম সময়ে। এসব পণ্যের বাইরে অন্য যে কোনো ক্ষেত্রে ডলার সংস্থান না করে এলসি না খোলার বিষয়ে সতর্ক করা হচ্ছে। ফলে এখন রপ্তানি আয়ের বিপরীতে ব্যাক টু ব্যাকের বাইরে এলসি হচ্ছে কম। বেশিরভাগ ব্যাংক এখন এলসি খোলার আগে আমদানিকারককে ডলার সংগ্রহ করার শর্ত দিচ্ছে। এছাড়া আগের দায় পরিশোধে দফায় দফায় সময় নিচ্ছে। ফলে নতুন প্রজšে§র ও ছোট ব্যাংক এলসি খোলা এক রকম বন্ধই রেখেছে। আমাদের নভেম্বর ও ডিসেম্বরে এলসি না খোলার জন্য বলা হয়েছে। এ কারণে আমাদের ছোট ও মাঝারি পর্যায়ের অনেক আমদানিকারক বিপাকে পড়েছে। অথচ একটা সময়ে আমরা ব্যাংকাররা এলসি দেয়ার জন্য গ্রাহকের কাছে যেতাম এবং অনুরোধ করতাম। এখন গ্রাহক আমাদের ১০০ শতাংশ মার্জিনে এলসি খোলার জন্য অনুরোধ করছে। অথচ এলসি দিতে পারছি না। বিষয়টা আসলে জটিল।

এ বিষয়ে এফএম ট্রেডার্সের কর্ণধার ও খাতুনগঞ্জ সাধারণ আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মহিউদ্দিন শেয়ার বিজকে বলেন, খাতুনগঞ্জ এলাকার ব্যাংকের শাখাগুলো অঘোষিতভাবে এলসি নেয়া বন্ধ করে রাখছে। এ কারণে আমাদের ছোট ও মাঝারি পর্যায়ের অনেক আমদানিকারক বিপাকে পড়েছেন। আমাদের পেমেন্ট নিয়মিত রয়েছে। অথচ বড় কিছু গ্রাহকের এলসি নেয়া হচ্ছে। এভাবে হলে তো বড়রা বাজার নিয়ন্ত্রণ করবে। চিনির মতো ভোগ্যপণ্যের দাম তারাই নিয়ন্ত্রণ করবে। এতে বাজারের মনোপলি ব্যবসা শুরু হবে, যা কারও জন্য ভালো হবে না। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক বলে ডলার সংকট নেই। তাহলে ব্যাংকগুলো কেন এলসি দিচ্ছে না?

তিনি আরও বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধসহ নানা কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে বিভিন্ন পণ্যের চাহিদা কমছে। একই সঙ্গে দেশে দেশে ভোক্তা মূল্যস্ফীতির কারণে ভোগ ব্যয় কমছে। ফলে ভোক্তার ভোগ ও চাহিদা কমে যাওয়ায় আমদানিকারক দেশ থেকে পণ্য বুকিং কমতে শুরু করেছে। আর সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনও কমছে। কিন্তু ডলারের সংকটের কারণে আমরা আমদানি করতে পারছি না। এখন তো মনে হচ্ছে ভোগ্যপণ্য সংকট হবে।

এ বিষয়ে পিএইচপি ফ্যামিলির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমির হোসেন সোহেল বলেন, এমন কঠিন সময় আসলেই ভাবনার। সিঙ্গাপুরের একজন সরবরাহকারী পেমেন্টের জন্য বারবার তাগাড়া দিচ্ছেন। অথচ ডলার সংকটের কারণে ব্যাংক এলসির পেমেন্ট দিতে পারছে না। এভাবে আর কয়েক মাস গেলে আমাদের দীর্ঘমেয়াদি মন্দায় পড়তে হবে। কারণ অপ্রত্যাশিত হারে আমাদের শিল্প-কারখানাগুলোয় বিক্রয় কমেছে। এতে অনেক প্রতিষ্ঠানের টিকে থাকাটাই কঠিন হয়ে পড়বে।