ইসমাইল আলী:ঢাকা-টঙ্গী রেলপথ ৩য় ও ৪র্থ লাইন নির্মাণ প্রকল্প নেয়া হয় ২০১২ সালের নভেম্বরে। তবে সাড়ে ৯ বছরে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়েছে অর্ধেকের কিছু বেশি। ভুল পরিকল্পনা ও দুই দফা দরপত্র বাতিলের কারণে প্রকল্পটি পিছিয়ে যায়। এখন চলছে জমি নিয়ে জটিলতা। নির্মাণাধীন ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে ঢাকা-টঙ্গী ৩য় ও ৪র্থ লাইন নির্মাণ। প্রকল্পের জমি এখনও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বুঝিয়ে দেয়া যায়নি।
প্রকল্প দুটি বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ রেলওয়ে ও বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের যৌথ পরিদর্শন প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। সংস্থা দুটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও পরামর্শকরা সম্প্রতি যৌথভাবে প্রকল্প দুটি পরির্দশন করেন। এর ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি প্রণয়ন করা হয়েছে।
এতে জানানো হয়, ২৮ এপ্রিল ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প থেকে পিয়ারওয়ারী কনস্ট্রাকশন সাইট ও মালামাল স্টক এলাকা হস্তান্তর পরিকল্পনা রেলওয়েকে পাঠানো হয়। এ বিষয়ে ঢাকা-টঙ্গী ৩য় ও ৪র্থ লাইন নির্মাণ প্রকল্প থেকে কিছু নির্মাণ সাইট ও মালামাল স্টক এলাকা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে হস্তান্তরের অনুরোধ করা হয়। এতে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) মধ্যস্থতায় ২৬ মে বৈঠক করে দুই পক্ষ।
বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুসারে ২৯ মে প্রকল্প দুটি পরিদর্শন করা হয়। তবে তা ঢাকা-টঙ্গী ৩য় ও ৪র্থ লাইন নির্মাণের জন্য খুব একটা ফলপ্রসূ হয়নি। বাংলাদেশ রেলওয়ে থেকে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের জন্য বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ কর্তৃক জমি লিজ গ্রহণের সময়ে শর্ত ছিল, কোনোক্রমেই ৩য় ও ৪র্থ লাইন নির্মাণ প্রকল্পের কাজ বাধাগ্রস্ত করা যাবে না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণকাজের জন্য এ প্রকল্পের কাজ বিশেষভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
ঢাকা-টঙ্গী ৩য় ও ৪র্থ লাইন নির্মাণ প্রকল্পের মেয়াদ আগামী বছর জুন পর্যন্ত ধরা আছে। তবে সম্পূর্ণ সাইট ঠিকাদারকে এখনও বুঝিয়ে দেয়া যায়নি। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়ন বিলম্বিত হচ্ছে। ফলে বাংলাদেশ সরকারকে ভারতের এক্সিম ব্যাংকের কমিটমেন্ট ফি পরিশোধ করতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে সৃষ্ট সমস্যা সমাধানে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পকে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করা হয়।
যৌথ পরিদর্শন প্রতিবেদনে ঢাকা-এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মাঠপর্যায়ের বিস্তারিত অগ্রগতি তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়েছে, রাজধানীর কাওলা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ৩২ দশমিক ৬৫ কিলোমিটার অংশে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সঙ্গে ঢাকা-টঙ্গী ৩য় ও ৪র্থ লাইন নির্মাণ প্রকল্পের ওভারল্যাপিং রয়েছে। এর মধ্যে ২৮ দশমিক ৩৮ কিলোমিটার সাইট রেলপথ নির্মাণের জন্য এখনও ক্লিয়ার নয়। এছাড়া যেসব স্প্যানে এক্সপ্রেসওয়ের ডেক সø্যাব স্থাপন সম্পন্ন হয়েছে, সেসব স্প্যানের নিচের অংশ রেলের মালামাল রাখার জন্য খালি করার অনুরোধ করা হয়েছিল। তবে মাত্র ছয়টি স্প্যানের নিচে আংশিকভাবে রেলের মালামার রাখার অনুমতি দেয়া হয়েছে।
সাইট পরির্দশনে দেখা যায়, এক্সপ্রেসওয়ের ১-১৮ নং পিয়ার পর্যন্ত কোনো ওভারল্যাপিং নেই। ১৮-২০ পর্যন্ত পিয়ারের ৬০ মিটার সাইট আগামী বছর জুনে রেলওয়েকে হস্তান্তর করা হবে। যদিও ঢাকা-টঙ্গী ৩য় ও ৪র্থ লাইন নির্মাণ প্রকল্প থেকে ১৮-২০ নং পিয়ার পর্যন্ত অর্ধেক যান চলাচলের জন্য উপযোগী করার অনুরোধ করা হয়। তবে আগামী ডিসেম্বরের পর তা হস্তান্তর করা হবে বলে এক্সপ্রেসওয়ে কর্তৃপক্ষ জানায়। এছাড়া ২০-২৩ নং পিয়ারের ওপর ডেক সø্যাব স্থাপন সম্পন্ন হয়েছে। এ অংশটি চলতি মাস শেষে রেলওয়ের কাছে হস্তান্তর করা হবে বলে জানানো হয়। যদিও দুই সপ্তাহের মধ্যে তা হস্তান্তরের অনুরোধ করেছিল রেলওয়ে। তবে সে অনুরোধ রাখেনি এক্সপ্রেসওয়ে কর্তৃপক্ষ।
এদিকে এক্সপ্রেসওয়ের ২১-৩২ পর্যন্ত পিয়ারের অংশে রেলের অ্যালাইমেন্টের পাশে বিভিন্ন স্টিল শাটারিং ও ফর্মওয়ার্ক স্টক করে রেখেছে এক্সপ্রেসওয়ে কর্তৃপক্ষ, যা প্রকল্পটির জন্য প্রয়োজন নেই। এগুলো পূর্ব পাশে খালি জায়গায় স্থানান্তর করে এক সপ্তাহের মধ্যে রেলের কাজের জন্য খালি করে দেয়ার অনুরোধ করা হয়। এছাড়া ২৪-২৫ পিলারের মাঝে রেলের এমব্যাংকমেন্টের ওপর এক্সপ্রেসওয়ের ঠিকাদার বাঁশ চাছার কাজ করছিল, যার ফলে এমব্যাংকমেন্টের বালি নষ্ট হচ্ছিল। তা বন্ধ করার জন্য এক্সপ্রেসওয়ে কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করে ঢাকা-টঙ্গী ৩য় ও ৪র্থ লাইন নির্মাণ প্রকল্প কর্তৃপক্ষ।
এর বাইরে এক্সপ্রেসওয়ের ৩৫-৬৪ নং পিয়ারের রাস্তার ক্লিয়ার রেখে এক্সপ্রেসওয়ের স্প্যানের নিচের জায়গা রেলওয়ের মালামাল রাখার অনুমতি চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেখানে রেলের মালামাল রাখা সম্ভব নয় বলে জানায় এক্সপ্রেসওয়ে কর্তৃপক্ষ। এক্ষেত্রে ৩০-৩১, ৫৭-৫৮ ও ৬০-৬১ এ তিনটি স্প্যানের নিচের জায়গা রেলের মালামাল রাখার জন্য দেয়া হবে বলে জানানো হয়। তবে তা পাথর রাখার জন্য যথেষ্ট নয় বলে জানায় রেলওয়ে।
অপরদিকে রেলের অ্যালাইমেন্টের পাশের স্থানের পরিবর্তে এক্সপ্রেসওয়ে থেকে রেললাইন দূরে অবস্থিত ৮৩-৮৭ ও ৯১-৯৯ নং পিয়ারের লোকেশনে আই-গার্ডার বহনের রাস্তা রেখে স্প্যানের নিচের জায়গা ব্যালাস্ট রাখার জন্য দেয়া হবে বলে প্রস্তাব করে এক্সপ্রেসওয়ে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু অ্যালাইমেন্ট থেকে দূরে ও তার মধ্যে কুড়িল ফ্লাইওভারের লুপ ও লেক থাকায় মালামাল রাখলে নির্মাণ অগ্রগতি ব্যাহত হবে। এছাড়া প্রস্তাবিত লোকেশন রেলের জমি নয়। আর ওই জমি প্রাইভেট বাস ও গাড়ি রাখার কাজে ব্যবহƒত হচ্ছে, যার জন্য পরবর্তীকালে সমস্যা হতে পারে।
এক্সপ্রেসওয়ের সাইট হস্তান্তর পরিকল্পনা অনুযায়ী, ১২৫-১৭১ নং পিয়ার পর্যন্ত অংশ রেলের কাজের জন্য আগামী ৩১ ডিসেম্বর হস্তান্তর করা হবে। একইভাবে ২০০-২২৪ নং পিয়ার পর্যন্ত অংশও একই সময়ে হস্তান্তর করা হবে। এছাড়া বনানী স্টেশন এলাকা নির্মাণকাজের জন্যও সাইট ৩১ ডিসেম্বর হস্তান্তর করা হবে বলে জানানো হয়।
জানতে চাইলে ঢাকা-টঙ্গী ৩য় ও ৪র্থ লাইন নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক নাজনীন আরা কেয়া বলেন, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প কর্তৃক জমি হস্তান্তর না করে এবং লিজ শর্ত ভঙ্গ করে, যা প্রকল্পের কাজ বাধাগ্রস্ত করছে। এ বিষয়ে সেতু কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করা হচ্ছে। তবে বিষয়টির এখনও সমাধান করা যায়নি।
উল্লেখ্য, ঢাকা-টঙ্গী রেলপথ ৩য় ও ৪র্থ লাইন এবং টঙ্গী-জয়দেবপুর ডাবল লাইন নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৮৪৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা। তবে প্রকল্পটির ডিটেইল ডিজাইন ও টেন্ডারিং সার্ভিস পর্যায়ে পরামর্শক সেবা অন্তর্ভুক্ত ছিল না। এজন্য এক দফা প্রকল্পটি সংশোধন করা হয়। এগুলো সংশোধনের পাশাপাশি ৯০ পাউন্ডের রেলের পরিবর্তে ৫২ কেজির রেলের সংস্থান রাখা হয়। এতে প্রকল্প ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় এক হাজার ১০৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা। তবে শেষ পর্যন্ত প্রকল্প ব্যয় বেড়ে আড়াই হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।