Print Date & Time : 19 June 2025 Thursday 8:26 pm

এশিয়া প্যাসিফিক বিজনেস ফোরামে বক্তারা: বাণিজ্যসহায়ক পরিবেশ তৈরিতে অগ্রগতি সামান্য

 

নিজস্ব প্রতিবেদক: বিশ্বায়নের সুযোগ নিতে পারেনি স্বল্পোন্নত দেশগুলো। গত ২০ বছরে বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি চারগুণ বেড়েছে। কিন্তু এই বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক যোগাযোগের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে স্বল্পোন্নত দেশগুলো। দেশগুলোতে বাণিজ্যসহায়ক পরিবেশ তৈরিতে অগ্রগতি সামান্যই। এসব দেশের উন্নয়নে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাগুলোর বাস্তবায়ন জরুরি। সেজন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যাপক হারে সম্পৃক্ত করতে হবে। উন্নয়নের জন্য আঞ্চলিক পর্যায়ে যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। দক্ষিণ এশিয়ায় শুধু সার্ক নিয়ে না ভেবে বিবিআইএন, বিসিআইএন, বিমসটেকসহ নানা ব্যবস্থার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে সমন্বিত ট্যারিফ ব্যবস্থা চালু করতে হবে। ইউরোপের বাজারে চলমান অস্ত্র বাদে সবকিছু (ইবিএ) ব্যবস্থার মতো এশিয়া প্যাসিফিক এলাকায়ও দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে মুক্তবাণিজ্যের উদ্যোগ নিশ্চিত করতে হবে। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে  সেনসিটিভ লিস্ট শূন্যে নামাতে হবে।

এশিয়া প্যাসিফিক বিজনেস ফোরামের দুদিনব্যাপী সম্মেলনের আলোচনায় এসব প্রস্তাব দেওয়া হয়। গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে এ সম্মেলনের সমাপ্তি হয়। এর আগে বুধবার বিকালে সম্মেলন উদ্বোধন করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোর সমন্বয়ে গঠিত এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ব্যবসায়ী মহল এতে অংশ নেয়। দেশগুলোর সরকারি প্রতিনিধিরাও অংশ নেন এতে।

সম্মেলনটি যৌথভাবে আয়োজন করে বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স (আইসিসিবি)। এতে বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশন ফর এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিক (ইএসসিএপি) সহায়তা করে। সম্মেলনে সাতটি আলাদা সেশনে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এতে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্পর্কবিষয়ক আলোচনায় বলা হয়, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোকে সামাজিকভাবে দায়বদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।

বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের পরিচালনায় ওই সেশনে বক্তব্য রাখেন নেপালের বাণিজ্যমন্ত্রী রোমি গাওচান থাকালি, প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. গওহর রিজভী, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা এম আজিজুল ইসলাম, আঙ্কটাড সেক্রেটারি জেনারেল ড. মুকিসা কিতুই, এডিবির ভাইস প্রেসিডেন্ট (পরিচালনা) ওয়েনচি ঝা, ইএসসিএপির নির্বাহী সেক্রেটারি ড. শামশাদ আখতার, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এসডিজি কার্যক্রমের মুখ্য পরিচালক আবুল কালাম আজাদ প্রমুখ। এতে ইএসসিএপির নির্বাহী সেক্রেটারি ড. শামশাদ আখতার বলেন, পৃথিবীর প্রবৃদ্ধির ৯০ শতাংশ ব্যক্তিমালিকানাধীন সূত্র থেকে আসছে। ব্যক্তি খাতের ভূমিকা শুধু কর্মসংস্থানেরই নয়, এদের সামাজিক দায়বদ্ধতাও রয়েছে। বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতায় করপোরেট সাফল্য আর বৈশ্বিক উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা মূলত একই।

প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী বলেন, আমাদের আঞ্চলিক যোগাযোগের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। পানি, বিদ্যুৎ, সন্ত্রাসবাদ, দারিদ্র্যের মতো সমস্যাগুলো মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। নেপালের বাণিজ্যমন্ত্রী রোমি গাওচান থাকলি বলেন, বিশ্বের ৬০ শতাংশ মানুষ দরিদ্র এবং গ্রামে বাস করে। গত ২০ বছরে পৃথিবীর প্রবৃদ্ধি হয়েছে চারগুণ। কিন্তু স্বল্পোন্নত দেশগুলো এই বৈশ্বিক উন্নয়নের সুযোগ নিতে পারেনি তাদের নানারকম কাঠামোগত সীমাবদ্ধতার কারণে। এ অবস্থার উন্নয়নে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর ক্ষুদ্র শিল্পগুলোকে বৈশ্বিক ভ্যালু চেইনের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বেসরকারি খাত নিজেই উন্নয়ন করতে পারবে না। এজন্য সরকার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সম্পৃক্তি প্রয়োজন। সরকারকে বৈষম্যহীনভাবে অর্থায়ন ব্যবস্থা করতে হবে। অবকাঠামোর উন্নয়নের পাশাপাশি দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। তবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বল্পমেয়াদি মুনাফার দিকে না তাকিয়ে সামাজিক দায়বোধ ও দীর্ঘমেয়াদি মুনাফার দিকে মনোযোগ দিতে হবে।

আঙ্কটাড সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, বিশ্বব্যাপী একটি বিশ্বায়নবিরোধী মানসিকতা তৈরি হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে জিন বিশ্বায়নের সুবিধা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। বিপরীত দিকে যুক্তরাষ্ট্র বিপরীত দিকে হাঁটছে। রাষ্ট্র ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো দুর্বল হচ্ছে। এ অবস্থায় বণিক সম্প্রদায় ও সরকারকে এক সঙ্গে কাজ করতে হবে। এ অবস্থায় দায়সারা সিএসআর ব্যবস্থা এড়িয়ে অবহেলিত জনগোষ্ঠীকে উন্নয়ন করার বাস্তব উদ্যোগ নিতে হবে।

এছাড়া আরও ছয়টি সেশনে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে জলবায়ু অভিঘাত মোকাবিলা, জ্বালানি খাতে নতুন বাস্তবতা, আঞ্চলিক সম্পর্কোন্নয়নে বাণিজ্য ও যোগাযোগ বৃদ্ধি, অংশগ্রহণমূলক ব্যবসার মাধ্যমে আর্থিক কাঠামো উন্নয়ন ও এসডিজি বাস্তবায়ন, সুবিধাবঞ্চিত এসএমই উন্নয়ন এবং উন্নয়নমুখী এশিয়ার প্রধান নীতিগত চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে আলাদা আলাদা আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।

এসব আলোচনায় বলা হয়, বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মধ্যেও (জি-২০) ব্যাপক হারে বাণিজ্যের ওপর বাধানিষেধ চলছে। বাংলাদেশ এখন ট্রেড ফেসিলিটেশন অ্যাগ্রিমেন্টের (টিএফএ) অংশ। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দরসহ বিভিন্ন বন্দরে বাণিজ্যসহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করা হচ্ছে না। আঞ্চলিক পর্যায়ে ভালো অগ্রগতি হচ্ছে না। বাস্তবে বাণিজ্যসহায়ক পরিবেশ তৈরিতে অগ্রগতি হয়নি।

প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বাণিজ্য উন্নয়নের দিকে গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে বক্তারা বলেন, ভারত ৫০০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে। চীন করে এক দশমিক আট ট্রিলিয়ন ডলার। ওইসব পণ্যের অনেকটাই সরবরাহ করার সক্ষমতা বাংলাদেশের থাকলেও বাংলাদেশ থেকে চীন ও ভারত আমদানি করছে না। আঞ্চলিক পর্যায়ের এই বাজারে প্রবেশাধিকার পেতে উদ্যোগ নিতে হবে। এসব বৈশ্বিক সমস্যার সমাধানও বৈশ্বিকভাবেই অর্জন করতে হবে। এসব ক্ষেত্রে আঞ্চলিক পর্যায়ে মুক্তবাণিজ্য এলাকা (এফটিএ) নিশ্চিত করতে হবে। রফতানি পণ্যের ওপর সেনসেটিভ লিস্ট শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে। ইবিএ’র মতো ব্যবস্থা চালু করতে হবে।

সম্মেলনে সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ মামুনের সঞ্চালনায় ডিজিটাল ব্যাংকিংবিষয়ক আলোচনায় বলা হয়, পৃথিবীর দুই বিলিয়ন মানুষের কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই। তাদেরও অর্থনৈতিক কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করতে হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে ‘বিকাশ’ উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। এ প্রসঙ্গে ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান আরাস্তু খান বলেন, ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের বিষয়ে ইসলামী ব্যাংকও উদ্যোগ নিয়েছিল ২০১২ সালে। কিন্তু এতে মানি লন্ডারিংয়ের ঝুঁকি ছিল। ভুয়া কাগজ দিয়ে আইডি খুলে লেনদেন করে নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হচ্ছিল। এসব কারণে কমপ্লায়েন্সের দিক বিবেচনায় সেটি চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে সরকার এ বিষয়ে একটি নীতিমালা করলে ইসলামী ব্যাংকও মোবাইল ব্যাংক এবং ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের দিকে অগ্রসর হবে। সেশনের পরিচালক বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সব ধরনের লেনদেনেই ঝুঁকি রয়েছে। এ বিষয়ে সরকারকে দায়িত্বশীল হতে হবে। সিনিয়র সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়ার পরিচালনায় এসএমইবিষয়ক সেশনে বলা হয়, এসএমইগুলোর উন্নয়নে অর্থনৈতিক জোন স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া দরকার। সম্মেলন শেষে প্রেস ব্রিফিংয়ে আইসিসিবি সভাপতি মাহবুবুর রহমান বলেন, দেশের উন্নয়নে কয়লা উত্তোলনের দিকে গুরুত্ব দিতে হবে।