সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডু উপজেলার জাহানাবাদ এলাকার তিন ভাই জাহাঙ্গীর আলম, ফরিদুল আলম ও খোরশেদ আলম। এ তিন ভাই জাহাজ আমদানি, জাহাজ ভাঙা এবং ইস্পাত উৎপাদনের একাধিক প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে গড়ে তুলে মাবিয়া গ্রুপ। কিন্তু ব্যবসা পরিচালনায় অদক্ষতা ও ঋণ অপব্যবহারের বিভিন্ন ব্যাংকের খেলাপি তালিকায় যুক্ত হয় মাবিয়া গ্রুপ। এর মধ্যে সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের (এসআইবিএল) ১২১ কোটি ২৪ লাখ টাকা খেলাপি হয়েছে গ্রুপটির দুই প্রতিষ্ঠান। পাওনা আদায়ে গত ৩০ মে মামলা করে ব্যাংকটি।
এর আগে দ্য সিটি, এবি ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, যমুনা ব্যাংক, ফিনিক্স ফাইন্যান্স এবং স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকসহ অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি তালিকায় নাম ওঠে মাবিয়া গ্রুপের। এবার নতুনভাবে এসআইবিএলের খেলাপির তালিকায় যুক্ত হলো মাবিয়া গ্রুপ।
সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক সূত্রে, মাবিয়া গ্রুপের দুই সহযোগী প্রতিষ্ঠান মেসার্স মাবিয়া শিপ ব্রেকার্স এবং মেসার্স মাবিয়া শিপ ব্রেকার্স ইউনিট-২ এ প্রয়োজনে সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের ঋণের জন্য ২০১২ সালের ১০ এপ্রিল আবেদন করে মাবিয়া গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম, যা ৭ আগস্ট ২০১২ সালে ১২০ কোটি টাকা পর্যন্ত লিমিটেড অনুমোদিত হয়। এ সুবিধায় ২০১৩ সালের ৭ মার্চ মেসার্স মাবিয়া শিপ ব্রেকার্স ইউনিট-২ এ নামে ৫৬ কোটি ৪৪ লাখ টাকায় ইলিয়ানা শিপিং লিমিটেডের মাধ্যমে লাইবেরিয়ার স্ক্রাব অয়েল ট্যাংকার আমদানি করে।
এ আমদানিকৃত জাহাজের বিপরীতিতে দুই বছর সাত মাস পর মাত্র দুই কোটি ৩৬ লাখ টাকা পরিশোধ করে জাহাঙ্গীর আলম। আর দীর্ঘসময় ধরে পাওনা অপরিশোধিত থাকায় মেসার্স মাবিয়া শিপ ব্রেকার্স ইউনিট-২ নামে সুদাসলে দেনা হয় ৮৭ কোটি ৫৮ লাখ ৭৫ হাজার ৯৯৪ টাকা। একইভাবে গ্রুপটির অপর আরেকটি প্রতিষ্ঠান মেসার্স মাবিয়া শিপ ব্রেকার্সের দেনা হয় ৩৩ কোটি ৬৫ লাখ ৪৭ হাজার ১৫৬ টাকা। এ দুই প্রতিষ্ঠানের মোট দেনার পরিমাণ হয় ১২১ কোটি ১৪ লাখ ২৩ হাজার ১৫০ টাকা। এর মধ্যে মূল ঋণের পরিমাণ ৭৯ কোটি আট লাখ ৯৮ হাজার ২৯১ টাকা।
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান সূত্রে, সীতাকুণ্ডুর জাহানাবাদ এলাকার মহরম আলীর তিন ছেলে জাহাঙ্গীর আলম, ফরিদুল আলম ও খোরশেদ আলম এ তিন সহোদর ২০০৮ সালে পর একে একে গড়ে তোলেন মেসার্স জিলানি ট্রেডার্স, ফাহিম স্টিল রি-রোলিং মিল, মাবিয়া শিপ ব্রেকার্স, মাবিয়া শিপ ব্রেকার্স ইউনিট-২, এফএমএস ইস্পাত শিপ ব্রেকিং, আলী স্টিল এন্টারপ্রাইজ এবং মেসার্স খাজা আজমীর করপোরেশনের সমন্বয়ে গড়ে তুলে মাবিয়া গ্রুপ। সময়ের সঙ্গে আস্তে আস্তে ব্যবসার পরিধি বাড়াতে থাকেন। কিন্তু তাদের অদূরদর্শী প্রকল্প গ্রহণ, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও ব্যবসায়িক অনভিজ্ঞতা ইত্যাদি বিবেচনা না করে আটটির অধিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ঋণ দেয়, যা এখন গলার কাটা হয়ে আছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থায়ন করে সিটি ব্যাংক।
বর্তমানে মাবিয়া গ্রুপের কাছে সিটি ব্যাংকের পাওনা প্রায় ১৬১ কোটি টাকা। একইভাবে বেসরকারি এবি ব্যাংকেরও পাওনা দাঁড়িয়েছে ১১৭ কোটি ২১ লাখ টাকা। এ ঋণের টাকা ফেরত পেতে এবি ব্যাংকও গ্রুপটির কর্ণধারদের বিরুদ্ধে গত ৯ নভেম্বর অর্থঋণ আদালতে মামলা দায় করে। এছাড়া বেসরকারি ব্যাংক মার্কেন্টাইল ব্যাংকের মাদামবিবিরহাট শাখারও এ গ্রুপের তিন সহযোগী প্রতিষ্ঠানের মেসার্স জিলানি ট্রেডার্স, ফাহিম স্টিল রি-রোলিং মিল এবং মাবিয়া শিপ ব্রেকার্সের নামে ঋণ আছে। যা বর্তমানে খেলাপি। ব্যাংকটির পাওনা ১০৩ কোটি ৪৮ লাখ ৪৫ হাজার ৯৯২ টাকা। আর এ খেলাপির জন্য জাহাঙ্গীর আলম ও খোরশেদ আলমের বিরুদ্ধে মামলা করে ব্যাংকটি। এছাড়া মাবিয়া শিপ ব্রেকিংয়ের কাছে ফিনিক্স ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টেরও ৯ কোটি টাকার বেশি খেলাপি ঋণ রয়েছে। গত বছর এ আর্থিক প্রতিষ্ঠানটিও গ্রুপটির বিরুদ্ধে মামলা করেছে। এর বাইরে যমুনা ব্যাংকসহ আরও কয়েকটি ব্যাংকের অর্থও মাবিয়া গ্রুপের কাছে আটকে আছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সূত্রে জানা যায়, মাবিয়া গ্রুপ গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জাহাজ ভাঙার জন্য কোনো জাহাজ আমদানি করেনি। তবে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের মাবিয়া গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান মাবিয়া শিপ ব্রেকার্স ৮৭ কোটি ৬৩ লাখ টাকায় একটি জাহাজ আমদানি করে।
বাংলাদেশ শিপ ব্রেকিং অ্যান্ড রিসাইকেল অ্যাসোসিয়েশনের একাধিক সদস্য ও কর্মকর্তারা জানান, এ গ্রুপের ব্যবসায়িক অবস্থা ভালো না। গত দুই বছরের অধিক সময় ধরে এ গ্রুপের জাহাজ ভাঙা ও ইস্পাত উৎপাদন বন্ধ আছে। আর সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তারা আড়ালে চলে যায়। কেউ দেশের বাহিরে অবস্থান করছে বলে শুনছি।
মাবিয়া গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। পরে এ গ্রুপের পরিচালক ফরিদুল আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি পরিচয় পেয়ে ফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। পরে একাধিক বার ফোন করা হলে তিনি রিসিভ করেননি।