নিজস্ব প্রতিবেদক: ছোট ঋণগ্রহীতারা নিয়মিত কিস্তি জমা দেন। তারা ঋণখেলাপি হতে চান না। কিন্তু করপোরেট গ্রাহকরা রাজনৈতিক ও আর্থিকভাবে শক্তিশালী হওয়ায় অর্থ পরিশোধ করেন না। এজন্য বড় ঋণেই খেলাপির হার এখন ১০ শতাংশের ওপরে। এসএমইর চেয়ে করপোরেট খাতে বিনিয়োগই বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এসএমই খাতে বিনিয়োগে সবচেয়ে বেশি মুনাফা অর্জন করা যায় বলে অভিমত তুলে ধরেছেন ব্যাংক খাতের বিশেষজ্ঞরা।
‘বাংলাদেশের ব্যাংক কি এসএমইতে ক্লাস্টার ফাইন্যান্সিং করছে’ শীর্ষক কর্মশালায় এমন মন্তব্য করেন তারা। গতকাল কর্মশালাটির আয়োজন করে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম)। প্রতি বছর ‘ব্যাংকিং রিসার্চ ওয়ার্কশপ সিরিজ’ আয়োজন করে বিআইবিএম। এবার করোনা মহামারিতে অনলাইনে অনুষ্ঠিত হবে ধারাবাহিক কর্মশালাটি। গতকাল ছিল প্রথম পর্ব।
বিআইবিএমের মহাপরিচালক ড. মো. আখতারুজ্জামানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এসএম মনিরুজ্জামান। আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আইডিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফ খান ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী হোসেন প্রধানিয়া।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসএম মনিরুজ্জামান বলেন, ব্যাংক যখনই বিনিয়োগ করতে এটি বাণিজ্যিকভাবে সফল হতে হয়। এটি না হলে ব্যাংকগুলো আগ্রহী হবে না। এজন্য এসএমই প্রতিষ্ঠান নির্বাচনে এলাকাভিত্তিক অগ্রাধিকার বিষয়গুলো চিহ্নিত করা যেতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে রিটার্ন ভালো, সেখানে পর্যক্ষেণ ভালো হয়েছে। সেখানে ব্যাংকগুলো যেতে পারে। এজন্য প্রযুক্তিকে ব্যবহার করা যায়।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিআইবিএমের অধ্যাপক শাহ মো. আহসান হাবীব। প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়, আমরা যখন বড় ফার্মকে অর্থায়ন করি তারা অনেক সুবিধা উপভোগ করে। কিন্তু ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো তা উপভোগ করতে পারে না। কিন্তু একই ধরনের এসএমই প্রতিষ্ঠানগুলোকে একটি প্ল্যাটফর্মে আনা যেতে পারে। তাদের চাহিদাকৃত কাঁচামাল একসঙ্গে আমদানি ও সমন্বিত বাজার ব্যবস্থাপনায় মার্কেটিং করা যেতে পারে। এতে তাদের উৎপাদন ও বিপণন খরচ কমে যাবে। গুচ্ছভাবে তাদের অর্থায়ন করা সম্ভব হবে। তাহলে ব্যাংকগুলোও এগিয়ে আসবে।
অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে আরিফ খান বলেন, অনেকেই বলছেন এসএমই খাত ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু করপোরেট বিনিয়োগই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এটি বিশ্বাস করতে হবে এসএমএই অর্থায়ন সবচেয়ে বেশি লাভজনক। এটি করার জাদুকরী মন্ত্র হচ্ছে, বিনিয়োগের খাত বাছাই করা। নিয়মনীতি অনুযায়ী ভালো গ্রাহকদের ঋণ দিতে হবে। ক্ষুদ্র গ্রাহকরাই অর্থ পরিশোধ করে। কিন্তু করপোরেটরা ক্ষমতাবান হওয়ায় তারা অর্থ পরিশোধ করছে না। এজন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এসএমই খাতে বিনিয়োগ করতে পারে।
ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখেই আইডিএলসির অন্যান্য খাতের বিনিয়োগ থেকে এসএমই খাত থেকে মুনাফার হার সবচেয়ে বেশি। সামগ্রিকভাবে আইডিএলসির বিনিয়োগ থেকে মুনাফার হার দেড় শতাংশ, কিন্তু এসএমই খাত থেকে দুই শতাংশ হারে রিটার্ন আসে। এসএমই অর্থায়ন সবচেয়ে বেশি মুনাফা করা সম্ভব।’
আইডিএলসির উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা ১৫ বছর আগে এ খাতে বিনিয়োগ শুরু করি। বর্তমানে আইডিএলসি এ খাতের বিনিয়োগ দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার কোটি টাকা। গ্রাহক সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার। ঋণখেলাপি হার হচ্ছে মাত্র তিন শতাংশ। মোট বিনিয়োগের ৩৬ শতাংশই এসএমই খাতে। যদিও এখনও এসএমইতে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ। তারপরও আমরা ক্রমেই ভালো করছি। খেলাপি ঋণের মাত্রা আমরা সহনীয় মাত্রায় রাখতে পেরেছি।’
আলী হোসেন প্রাধানিয়া বলেন, এসএমই খাতের বিনিয়োগ তুলনামূলক ব্যয়বহুল। কিন্তু আদায়ের হার বেশি। কৃষি ব্যাংকও এটি পেয়েছে। দেশের অর্থনীতির বিকাশে এ খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
মূল প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এসএমই অর্থায়ন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হয়। বর্তমানে ব্যাংকগুলোকে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। কিন্তু এটির চেয়ে কারও মাধ্যমেও অর্থায়ন করা যেতে পারে। যারা ভালো করছে, তাদের কাছ থেকেও সার্টিফিকেট নিয়ে ধার দেওয়া যেতে পারে। প্রায়ওরিটি সেক্টর লেন্ডিংয়ে যেতে পারে। তাহলে এটি আরও ভালোভাবে করা যেতে পারে। এসএমইতে যারা বিনিয়োগ করবে তাদের সহযোগিতা করতে হবে নীতিমালা দিয়ে।
উদাহরণ দিয়ে বলেন, চালকল মিলগুলোকে একসঙ্গে নিয়ে এসে বিনিয়োগ করা যেতে পারে। এসএমএই ফাইন্ডেশন ক্লাস্টার ফাইন্যান্সিংয়ের জন্য চালকল এ ৩৪টি, কুটির শিল্পে ৩৮টি, হালকা শিল্পে ৩১টি, জামদানি শিল্পে ৩৮টি ও পাদুকা শিল্পে ১৩টি প্রতিষ্ঠানকে গুচ্ছভাবে অর্থায়ন করার তালিকা রেছে। এসএমই উন্নয়নে বাংলাদেশ ব্যাংক এ পর্যন্ত ১০ হাজার ২৪৫ কোটি টাকা ঋণ স্থিতি রয়েছে। যার মধ্যে ক্লাস্টার ফাইন্যান্সিং হচ্ছে ছয় দশমিক ১১ শতাংশ।
ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ব্যাকওয়ার্ড ও ফরওয়ার্ড লিংকেজ প্রতিষ্ঠানেরর বিকাশে এসএমই ও কুটির শিল্প একটি সংযোগ হতে পারে। তদারকি খরচ কমিয়ে আনা সম্ভব। এসএমই ক্লাস্টার অর্থায়নে গ্রামীণ এলাকায় বাংলাদেশ ব্যাংক ও স্থানীয় সরকার বিভাগ যেমন কৃষি, মৎস্য, মৃত্তিকা বিভাগগুলো একসঙ্গে কাজ করতে পারে। এটি হলে ব্যাংকের হয়ে এ দলটি রক্ষাকবচ কাজ করতে পারে। তখন এত বেশি পর্যবেক্ষণ করার প্রয়োজন হবে না।
অনুষ্ঠানটির সঞ্চালনা করেন বিআইবিএমের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মাদ সোহাইল মুস্তফা। মূল প্রবন্ধ তৈরির দলে ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের এসএমই বিভাগের মহাব্যবস্থাপক হোসনে আরা শিখা, বিআইবিএমের অধ্যাপক নেহাল আহমেদ, ফ্যাকাল্টি মেম্বার রওশান জাদিদ, এসএমই ফাইন্ডেশনের মহাব্যবস্থাপক ফারজানা খান ও বাংলাদেশ ব্যাংকের উপপরিচালক জান্নাতুল ফেরদৌস তানিয়া।