নিজস্ব প্রতিবেদক: আইএমএফের শর্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়ে খসড়া কাস্টমস অ্যাক্ট ও খসড়া আয়কর আইন আগামী জুনের মধ্যে বিল আকারে পাস করে ১ জুলাই থেকে কার্যকর করার পরিকল্পনা করছে সরকার। তাড়াহুড়া করে আইন দুটি প্রণয়ন ও প্রয়োগ করতে গিয়ে যেন সাধারণ মানুষের ওপর বাড়তি করের চাপ দেয়া না হয় এবং দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকে গুরুত্ব দেয়াসহ ২৩ প্রস্তাব দিয়েছে রোববার ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ)। গতকাল রাজধানীর আগারগাঁওয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সম্মেলন কক্ষে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রাক-বাজেট আলোচনায় ইআরএফের পক্ষে বাজেট প্রস্তাবনা তুলে ধরেন সংগঠনের সভাপতি মোহাম্মদ রেফায়েত উল্লাহ মীরধা। সভায় এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম সভাপতিত্ব করেন।
ইআরএফের বাজেট প্রস্তাবে বলা হয়, এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে জীবনযাত্রার ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। ভারতের চেয়েও বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির হার বেশি। ভারত সরকারের সম্প্রতি ঘোষিত বাজেটে করমুক্ত আয়সীমা বাড়িয়ে ৭ লাখ রুপি নির্ধারণ করেছে। বাংলাদেশের সীমিত আয়ের জনগণকে কিছুটা স্বস্তি দিতে ব্যক্তি খাতে করমুক্ত আয়সীমা ৫ লাখ টাকা নির্ধারণ করা যেতে পারে। আইএমএফের শর্ত পূরণ করতে আগামী বাজেটে কর-জিডিপির অনুপাত শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ বাড়াতে হবে, পরের দুই বছরও শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ ও শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ হারে বাড়াতে হবে। এ বাড়তি রাজস্ব আহরণে করের হার না বাড়িয়ে করের আওতা বাড়ানো, অটোমেশনের মাধ্যমে কর কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করা। ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের ধাক্কা সামলাতে এখন থেকেই গতিশীল রাজস্ব প্রশাসন গড়ে তোলার কথা বলছে ইআরএফ।
সংগঠনটি ডব্লিউটিও বাউন্ড ট্যারিফ কার্যকর করার প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম আগামী অর্থবছর থেকেই শুরু করা দরকার। এলডিসি গ্রাজুয়েশন পরবর্তী প্রতিযোগিতামূলক অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকার জন্য দেশীয় শিল্পের সক্ষমতা বাড়াতেও পদক্ষেপ নেয়ার কথা জানিয়েছে। এলডিসি উত্তরণ-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (এফটিএ) বিষয়টি বিবেচনায় রেখে শুল্কহার যৌক্তিক করার কাজ আগামী বাজেট থেকেই শুরু করার প্রস্তাব করার কথা বলছে ইআরএফ। শুল্কহার এলডিসিগুলোর গড় শুল্কহারের তুলনায় বেশি এবং প্রোটেকটিভ ট্যারিফ গড়ে ২৮ শতাংশ উল্লেখ করে প্রস্তাবনায় বলা হয়, এ হার কমিয়ে আনার প্রস্তাব করা, যাতে এফটিএ করার পর রাজস্বের ধাক্কা একবারে না আসে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডো চালু করা, নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এনবিআরের বিভিন্ন সেবা বিডা’র ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টারে যুক্ত করা বিভিন্ন সেবা ফি অনলাইনে এক সিøপে নেয়ার ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে। সরকার বিভিন্ন খাতে যে কর অব্যাহতি দিয়ে আসছে, এবং এর ফলে অর্থনীতিতে কী ধরনের সুবিধা আসছেÑতার একটি পর্যালোচনা প্রতিবেদন চেয়েছে এনবিআর।
বেসরকারি খাতে কর অব্যাহতির সুবিধা ৩ বছর করা, আগাম কর রিফান্ড ব্যবস্থা শক্তিশালী করা, ইটিআইএনধারীদের রিটার্ন দাখিলে বাধ্য করা, রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তাদের দক্ষতা অর্জনে বিনিয়োগ বাড়ানো ইত্যাদি। পাচার করা অর্থ দেশে আনার জন্য এবারের বাজেটে যে সুবিধা দেয়া হয়েছে, তার সুফলও মিলছে না উল্লেখ করেএ অবস্থায় মুদ্রা পাচার রোধে ভারত, চীন অথবা দক্ষিণ কোরিয়ার মতো কঠোর আইন প্রণয়নের সুপারিশ ছাড়াও পরিবেশবান্ধব বা সবুজ শিল্পায়নে বিনিয়োগ উৎসাহিত করার করার প্রস্তাব দিয়েছে ইআরএফ।
এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, বাজেট করা হয় নি¤œ শ্রেণির অবস্থার উন্নতির জন্য। লোয়ার মিডল ক্লাসকে মিডল ক্লাসে আনার জন্য। মিডল ক্লাসকে আপার মিডল ক্লাসে নেয়ার জন্য। পার কেপিটা ইনকাম বাড়ানো জন্য। কিন্তু আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি, আমরা কী পেলাম, আমার হাতে এনে দাও, আমার কাছে এনে দাও। এটা আমাদের অভ্যাস হয়ে গেছে। বাজেটে কোথায় ট্যাক্সের ছাড় দেয়া হয় সেটা আমরা দেখি। ২০২১ সাল থেকে মেইড ইন বাংলাদেশ ধারণা নিয়ে আমরা বাজেট প্রণয়ন করি। মধ্যশ্রেণির সংখ্যা বেশি। তাদের কনজ্যুমার আইটেম ও বেশি। এ সাইজটার ডিমান্ডটা পূরণ করছে বিদেশ থেকে আনা আমদানি। মোবাইলফোন থেকে শুরু করে প্রেশার কুকার, টিভি ও ফ্রিজ। আমরা চাই বিদেশ থেকে ইম্পোর্টের শেয়ার জিরো হয়ে যাক। এটাকে টার্গেট করে যদি আমরা ইন্ডাস্ট্রিশিয়াল ডেভেলপমেন্টকে সাপোর্ট করি আমাদের পলিসি দিয়ে, তাহলে আমাদের জিডিপি, ফরেন কারেন্সি সেভিংস, ফরেন কারেন্সি ইনকাম, কর্মসংস্থান সমস্যা দূর হবে।
তিনি বলেন, এবার রিটার্ন দাখিল ৩২ থেকে ৩৫ লাখ হবে। এতে নতুন করদাতা বাড়বে ১০ লাখের মতো। আমাদের হেভি ইন্ডাস্ট্রিতে যেতে হবে, বড় বড় ইনভেস্টে যেতে হবে। চ্যালেঞ্জিং ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে যেতে হবে। সেখানে দেশের বড় গ্রুপকেই যেতে হবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য এসএমইতে যেতে হবে। বড়রা যদি এসএমইয়ের জায়গাটা খেয়ে দেয় তাহলে বড় ইনভেস্টমেন্ট কোথা থেকে আসবে। বড় শিল্পগোষ্ঠী চানাচুর বানাতে যায়। তাহলে ছোট উদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এখানে কে কোন ব্যবসা করবে সেটা নির্দিষ্ট করে দেয়ার দরকার আছে। এটা আমাদের বিষয় না। শিল্প, বাণিজ্য থেকে এটা ঠিক করে দেয়ার কথা বলেছি। এটা মনে হয় দেখার দরকার আছে। কারণ কোম্পানি আইনে নাকি এ সুযোগ অবারিত করে দেয়া আছে। দরকার হলে সেই আইন ঠিক করতে হবে।
সিগারেটের প্যাকেটে উল্লেখিত দামের চেয়ে বাড়তি দামে বিক্রি করার সুযোগ নেই বলে সাফ জানিয়েছেন এনবিআর চেয়ারম্যান। কারণ সিগারেট কোম্পানির লাভ ও বিক্রেতার কমিশন হিসাব করেই এনবিআর খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে দেয়। তাই প্যাকেটের উল্লেখ করা খুচরা দামের চেয়ে বেশি দাম বিক্রি বন্ধের কথা জানান তিনি। সিগারেট কোম্পানিগুলো প্রতিদিন ২০ কোটি টাকা জনগণের কাছ থেকে বেশি নিচ্ছে এ গণমাধ্যমে এ সংক্রান্ত প্রচারিত প্রতিবেদনের আলোকে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে এসব কথা বলেন এনবিআর চেয়ারম্যান। বলেন, ভোক্তাদেরও উচিত বাড়তি দাম সিগারেট না কেনা এবং সচেতন হওয়া। এ বিষয়ে বাজার তদারকিতে ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে চিঠি দেয়া হবে বলে জানান এনবিআর চেয়ারম্যান। একই সঙ্গে কোম্পানিগুলোর কাছে জানতে চাইব কেন তারা প্যাকেটের গায়ের চেয়ে বেশি দামে ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করছে।