আতাউর রহমান: গ্রাহকের মোবাইল ফোনে স্মল ক্যাপ প্ল্যাটফর্মে (এসএমই মার্কেট) তালিকাভুক্ত ১০ কোম্পানির লক-ইন শেয়ারের মিথ্যা তথ্য পাঠিয়ে পুঁজিবাজারে প্যানিক সৃষ্টি করছে বলে গত বুধবার অভিযোগ করেছেন মো. আলমাস হোসেন তুহিন নামে ইবিএল সিকিউরিটিজ লিমিটেডের একজন গ্রাহক। তিনি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম বরাবর অভিযোগ জানিয়ে বলেছেন, ইবিএল সিকিউরিটিজ উদ্দেশ্যমূলকভাবে শেয়ার মার্কেট ধ্বংসের ষড়যন্ত্রের নীলকশা বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে গ্রাহকের মোবাইলে মিথ্যা তথ্য পাঠিয়ে প্যানিক সৃষ্টি করে মার্কেটের পতন ঘটিয়েছে। এতে অভিযোগকারীর গত তিন কার্যদিবসে প্রায় চার লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে, যা তদন্তপূর্বক ফেরত প্রদানসহ প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার আবেদন জানিয়েছেন।
এদিকে অভিযোগকারী মো. আলমাস হোসেন তুহিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অসৎ উদ্দেশ্যে অপপ্রচার চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ তুলেছে ব্রোকারেজ হাউসটির কর্তৃপক্ষ, যার প্রতিকার চেয়ে গতকাল মতিঝিল থানায় সাধারন ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে। এছাড়া তিনি মিথ্যা ও ভুয়া তথ্য দিয়ে অভিযোগ ও অপপ্রচার চালিয়ে প্যানিক তৈরি এবং পুঁজিবাজার ও বিনিয়োগকারীদের ক্ষতির উদ্দ্যেশেই এমনটি করেছেন বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির এমডি মো. ছায়েদুর রহমান। তাই পুঁজিবাজার নিয়ে তার এমন অসৎ কাজের জন্য তাকে গ্রেপ্তারও করাও হতে পারে বলে জানিয়েছেন তিনি।
লিখিত অভিযোগে আলমাস হোসেন তুহিন বলেন, আমার গ্রাহক আইডি নং- ৪৬০৯৮। গত ১৭ আগস্ট এ অ্যাকাউন্টে থাকা শেয়ারের বাজারমূল্য ছিল ৪২ লাখ ১৩ হাজার টাকা। এ সপ্তাহের শুরুতে, অর্থাৎ ২১ আগস্ট থেকে ইবিএল সিকিউরিটিজ লিমিটেড পরিকল্পিতভাবে পর্যাক্রমে গ্রাহকদের মোবাইলে Lock in Information of the SME Board Companies শিরোনামে ১০টি কোম্পানির শেয়ারসংখ্যা-সংক্রান্ত মিথ্যা তথ্য পাঠায়। পরদিন এই এসএমএস আমার মোবাইলেও পাঠায়, যা মিথ্যা। উদ্দেশ্য প্রণোদিত মিথ্যা তথ্যের কারণে প্যানিক হয়ে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শেয়ার বিক্রির হিড়িক পড়ায় শেয়ারের দরপতন ঘটতে থাকে এবং গত তিন কর্মদিবসে বর্ণিত অ্যাকাউন্টে শেয়ারের বাজারমূল্য ৩৮ লাখ ১৭ হাজার টাকা দাঁড়ায়। অর্থাৎ তিন লাখ ৯৬ হাজার টাকা ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি। সঙ্গে মানবিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি, যা অপূরণীয় ক্ষতি।
অভিযোগে বলা হয়, ১০টি কোম্পানির মধ্যে একটি কোম্পানির শেয়ারসংখ্যা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, KBSEED (কৃষিবিদ সিড)-এর প্রকৃত শেয়ারসংখ্যা তিন কোটি। ডিরেক্টর হোল্ডিং ৫০ দশমিক ২০ শতাংশ এবং ইনস্টিটিউট হোল্ডিং ১১ দশমিক ১৩ শতাংশ। এই দুই ভাগ মিলে শেয়ার সংখ্যা দাঁড়ায় এক কোটি ৮৩ লাখ ৯৯ হাজার। তাহলে কীভাবে এক কোটি ৮৪ লাখ শেয়ার লকইন শেয়ার আছে? আর ডিরেক্টরদের একসঙ্গে সব শেয়ার সেল করার সুযোগ নেই। কী কারণে ডিরেক্টরদের শেয়ারগুলো অর্থাৎ কোম্পানির সব শেয়ার কথিত তারিখে বিক্রয়যোগ্য দেখানো হয়েছে? ডিরেক্টরদের সব শেয়ার একসঙ্গে বিক্রির সুযোগ কি বিএসইসি দিয়েছে?
এতে বলা হয়, এভাবে প্রতিটি কোম্পানির শেয়ারসংখ্যা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, অসৎ উদেশ্যে পরিকল্পিতভাবে মিথ্যা তথ্য-সংবলিত বার্তা পাঠিয়ে বর্ণিত অপপ্রচারের মাধ্যমে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের মধ্যে প্যানিক সৃষ্টি করে সেল প্রেশার বাড়িয়ে দরপতন ঘটিয়ে শেয়ার মার্কেট ধ্বংসস্তূপে নিয়ে কম দামে শেয়ার ক্রয়ের ষড়যন্ত্র করেছে ইবিএল, যা সিকিউরিটিজ আইনের পরিপন্থি। এভাবে বিনিযোগকারীদের আর্থিক ও মানসিক ক্ষতি করা হয়েছে, যার দায় ওই প্রতিষ্ঠানের ওপর বর্তায়। ৩০ লাখ বিনিযোগকারীর নিরাপত্তা বিধানের জন্য এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিএসইসিসি চেয়ারম্যানকে অনুরোধ করেন অভিযোগকারী। একই সঙ্গে বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনায় দ্রুত সময়ের মধ্যে তদন্তপূর্বক আর্থিক ক্ষতির তিন লাখ ৯৬ হাজার টাকা ফেরতের জন্য দাবিও জানান তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযোগকারী আলমাস হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, ইবিএল সিকিউরিটিজ থেকে এসএমই কোম্পানির শেয়ারের লক-ইন বিষয়ে মিথ্যা তথ্য ছড়িয়েছে। এতে কোম্পানির শেয়ার বিক্রির চাপ সৃষ্টি হয় এবং দাম কমে যায়, যার ফলে আমার ধারণকৃত অনেক এসএমই কোম্পানির শেয়ারে লোকসান দেখা দেয়। তাই এ বিষয়ে বিএসইসির কাছে আমি অভিযোগ জানিয়েছি।
তিনি এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা ও এমডির সঙ্গে কোনো কথা বলেছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই ঘটনার পর আমি ধারণকৃত সব শেয়ার আমার বিও হিসাবে স্থানান্তর করার জন্য আবেদন জানাই। তারা শেয়ার স্থানান্তরে দেরি করছে দেখে ব্রোকারেজ হাউসের এমডির কাছে গিয়ে কাজটি দ্রুত করে দিতে বলি এবং পরে সব শেয়ার স্থানান্তর করে দেয়।
অপরদিকে গতকাল ইবিএল সিকিউরিটিজের নামে বিনিয়োগকারী মো. আলমাস হোসেন তুহিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অসৎ উদ্দেশ্যে অপপ্রচার চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ তুলে এর প্রতিকার চেয়ে মতিঝিল থানায় সাধারন ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে। জিডিতে বলা হয়েছে, ইবিএল সিকিউরিটিজ লিমিটেড ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডের সাবসিডিয়ারি কোম্পানি এবং একটি স্বনামধন্য ব্রোকারেজ হাউস। এর গ্রাহক মো. আলমাস হোসেন তুহিন (গ্রাহক আইডি # ৪৬০৯৮ ও বিও # ১২০১৯৫০০৩৯৬১১৮২২) গত ২৪ আগস্ট বিএসইসি চেয়ারম্যানের বরাবর একটি অভিযোগ দাখিল করেন। ওই অভিযোগে তিনি কিছু মিথ্যা, বানোয়াট ও ভুল তথ্য এবং ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছেন বলে জিডিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. ছায়েদুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, তিনি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভুয়া তথ্য দিয়ে অভিযোগ করেছেন। সেইসঙ্গে বাজারে অপপ্রচার চালাচ্ছেন, যা বাজারের জন্য ক্ষতিকর। তাই বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করা হয়েছে এবং তার এ কার্যক্রমের জন্য তাকে গ্রেপ্তারও করা হতে পারে বলে জানান তিনি।
ইবিএল সিকিউরিটিজ থেকে যে তথ্য দেয়া হয়েছে, সে বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রথমত বিষয় হচ্ছে এসএমই কোম্পানির শেয়ার লক-ইনের বিষয়ে যে তথ্য আমরা তৈরি করেছি, তা গ্রাহকদের জন্য নয়। এটা আমাদের ইন্টারনাল ট্রেডারদের জন্য তৈরি করা হয়েছে। তিনি যে ট্রেডারের মাধ্যমে ট্রেড করেন তার কাছ থেকে অনুরোধক্রমে সেটা সংগ্রহ করেন। একজন ট্রেডার তার গ্রাহককে খুশি রাখতে তার অনুরোধ রেখেছে। তাই তথ্যটি যেসব গ্রাহকের কাছে পাঠানো হয়েছে, সেটা মিথ্যা।
দ্বিতীয়ত, তিনি যে অভিযোগ করেছেন সেখানে তার হিসাব অনুযায়ী কৃষিবিদ সিডের লক-ইন শেয়ারসংখ্যা এক কোটি ৮৩ লাখ ৯৯ হাজার। আর আমাদের দেয়া তথ্যে রয়েছে এক কোটি ৮৪ লাখ শেয়ার। তিনি হিসাব করেছেন ডিএসইতে দেয়া তথ্যের হিসাবে, আর আমরা করেছি প্রসপেক্টাসের তথ্য দিয়ে। সেখানে তার আর আমাদের হিসাবের মাঝে মাত্র এক হাজার শেয়ার পার্থক্য। তাহলে কি আমরা এক হাজার শেয়ার বেশি দেখিয়েছি বা হিসাব ভুল করেছি? না, আমরা বেশি দেখাইনি এবং ভুলও করিনি। বিষয় হচ্ছে ডিএসইতে শতকরা হিসাবে দেখানো হয়েছে, যে কারণে দশমিকের পর দুটি সংখ্যা দেখিয়েছে। এতে তার হিসাবে এক হাজার শেয়ার কম এসেছে। যদি প্রসপেক্টাস থেকে হিসাব করা হয়, তাহলে শেয়ারসংখ্যা এবং দশমিকের পর যে চার সংখ্যা থাকে, সেটা দিয়ে যোগ করলে এক হাজার শেয়ারের হিসাব পাওয়া যাবে। তাই তিনি এ ধরনের মিথ্যা এবং ভুয়া তথ্য পুঁজিবাজারে ছড়ানো এবং অভিযোগ করার কারণে তার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান তিনি।
বিষয়টি নিয়ে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, ইবিএল সিকিউরিটিজের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ এসেছে কি না, তা এ মুহূর্তে আমার জানা নেই। খোঁজ নিয়ে পরে জানানো যাবে।