এসিআই’র স্বপ্ন বুননের শুরুটা গল্পের মতো। বহুজাতিক কোম্পানির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে সফল এম আনিস উদ দৌলা। এসিআই’র পথচলা শুরুর আগে তিনি ব্রিটিশ অক্সিজেন গ্রুপের পাকিস্তান, কেনিয়া ও বাংলাদেশে দুই যুগেরও বেশি সময় (২৭ বছর) বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন। এর মধ্যে বাংলাদেশ অক্সিজেন লিমিটেডে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন এক যুগ। ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশে আইসিআই’র তিনটি কোম্পানির গ্রুপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক হন তিনি। প্রসঙ্গত, আইসিআই ১৯২৫ সাল থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রসায়ন-শিল্পে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। ১৯৬৮ সালে জীবন রক্ষাকারী ওষুধসামগ্রী উৎপাদনের জন্য নারায়ণগঞ্জে কারখানা নির্মাণ শুরু করে এ গ্রুপ।
বাংলাদেশে আইসিআই’র আনুষ্ঠানিক পথচলা শুরু ১৯৭৩ সালে। শুরু থেকে এদেশে লোকসান গুনছিল কোম্পানিটি। বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান হলেও বাংলাদেশের কার্যক্রমে তেমন চমক ছিল না। এম আনিস উদ দৌলা পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার পর চার বছরের মধ্যে লাভজনক হয়ে ওঠে প্রতিষ্ঠানটি। ৯০-এর দশকে বাংলাদেশে ব্যবসা বন্ধ করে আয়ের অর্থে মূল্য পরিশোধ, কোম্পানির সুনাম ও কর্মরতদের স্বার্থরক্ষার শর্তে কোনো বিনিয়োগ ছাড়াই আইসিআই বোর্ড এম আনিস উদ দৌলার কাছে প্রতিষ্ঠানটির মালিকানা বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৯২ সালে আইসিআই লিমিটেডের মালিকানা হস্তান্তরের মাধ্যমে অ্যাডভান্সড কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ (এসিআই) লিমিটেড নাম নিয়ে শুরু হয় আজকের এসিআই গ্রুপ।
শুরুতে ওষুধ ও কৃষি প্রক্রিয়াজাত-শিল্পের রাসায়নিক দ্রব্য তৈরি করলেও এসিআই এখন একটি পরিপূর্ণ গ্রুপ হিসেবে ব্যবসা করছে। এখন ফার্মাসিউটিক্যালস কিংবা অ্যাগ্রোকেমিক্যালসে ব্যবসা সীমাবদ্ধ নেই। ওষুধ, ভোগ্যপণ্য, কৃষি প্রক্রিয়াজাত ও প্রযুক্তিসহ নানা ক্ষেত্রে ব্যবসা সম্প্রসারণ করা হয়েছে। শুরুতে কৃষকের চাহিদা বিবেচনায় সার উৎপাদনে বিনিয়োগ করে এসিআই। এরপর মাটির পুষ্টি রক্ষা, অ্যাগ্রোনোমিক প্র্যাকটিস ট্রেনিং, সময়মতো ফসল বাজারজাতকরণ ও বাজার সম্ভাবনা বিবেচনায় নিয়ে এসিআইকে নানা খাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
নতুন পথপরিক্রমায় সব সময় পণ্যের গুণগত মান বজায় রেখে ক্রেতার সন্তুষ্টিকে প্রাধান্য দেয় এসিআই। একই সঙ্গে শুধু মুনাফাই নয়, বরং এসিআই’র বিনিয়োগের মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন। প্রাথমিক পর্যায়ের রাসায়নিক ও ওষুধনির্ভর ব্যবসায় সফল হয় তারা। পণ্যের মান, গ্রাহককেন্দ্রিকতা, সততা, স্বচ্ছতা, ক্রমাগত উন্নতি ও উদ্ভাবন এসব মূলমন্ত্রের ওপর ভিত্তি করে সময়ের সঙ্গে ব্যবসার পরিধি বেড়েছে। ৯০-এর দশকে আট কোটি টাকায় থাকা টার্নওভার এখন পাঁচ হাজার কোটিতে দাঁড়িয়েছে। সে সময়ের ২৩০ জন থেকে ১৫ হাজারের বেশি মানুষ এখন এসিআই পরিবারের সদস্য।
ওষুধ খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এসিআই। বর্তমানে ৫০০ ধরনেরও বেশি ওষুধ বাজারজাত করেছে এসিআই ফার্মাসিউটিক্যালস। এটিই বাংলাদেশের ওষুধ খাতে প্রথম আইএসও সনদপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান। দেশের ওষুধের চাহিদা মেটানোর পর শ্রীলঙ্কা, ইয়েমেন, মিয়ানমার, ভিয়েতনামসহ প্রায় ৩৫টি দেশে রফতানি করছে। পাশাপাশি এশিয়া, আফ্রিকা ও মধ্য আমেরিকার বিভিন্ন দেশে বাজার তৈরির চেষ্টা চলছে।
কৃষিপ্রধান দেশের কৃষকের চাষাবাদ প্রক্রিয়া আরও সহজ করে তোলার জন্য এসিআই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। শস্য সুরক্ষায় কীটনাশক তৈরি, উন্নতমানের সার উৎপাদন ও বিভিন্ন কৃষি মেশিনারি সরবরাহ করে প্রতিষ্ঠানটি। পাশাপাশি পশুস্বাস্থ্যের জন্য বিভিন্ন ধরনের ভ্যাকসিন ও ওষুধও বাজারজাত করছে। ২০০৮ সালে উন্নতমানের বীজ সরবরাহের স্বপ্ন নিয়ে এসিআই এ ব্যবসায় আসে।
কৃষি খাতে কাজ শুরুর পর সার, বীজ ও অ্যাগ্রোকেমিক্যালসের জন্য কৃষকের কাছে যাচ্ছে এসিআই। এরপর কৃষির সমন্বিতকরণের ব্যবস্থা নেয়। জমি চাষের জন্য চীন ও ভারত থেকে আনা ট্রাক্টর বিক্রি শুরু করে। এতে কৃষকের চাহিদা পূরণ হচ্ছে। অনেকে কৃষি যন্ত্রপাতি কিনে স্বাবলম্বী হচ্ছে। অনেক বেকার যুবক কৃষি যন্ত্রপাতি কিনে কৃষককে ভাড়া দিচ্ছেন। এতে বেকারের জীবিকার ব্যবস্থা হচ্ছে। অন্যদিকে স্বল্প সময়ে জমি চাষ করতে পারছে কৃষক। এজন্য সারা দেশে ১২টি সার্ভিস সেন্টার গড়ে তোলা হয়েছে। এর মাধ্যমে সার্ভিস ওরিয়েন্টেড ব্যবসাও করছে। এরপর ধান ও সবজির হাইব্রিড বীজ উৎপাদনে মনোযোগ দেয় এসিআই।
পরে ভোগ্যপণ্য বিপণন, আটা-ময়দা তৈরি, চিনি, সয়াবিন ও সরষের তেল, প্লাস্টিক পণ্য ও প্যাকেটজাত গুঁড়ো মসলা উৎপাদন-বিক্রি শুরু করে এসিআই। সময়ের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রায় সব খাতেই পা রেখেছে কোম্পানিটি।
কনজিউমার ব্র্যান্ড হিসেবে এসিআই’র কয়েকটি পণ্য সুনাম কুড়িয়েছে। গৃহস্থালির প্রয়োজনীয় অনেক সামগ্রী দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে। একইভাবে ক্রেতাদের পূর্ণ সন্তুটির ওপর ভর করে এগোচ্ছে এসিআই’র রিটেইল চেইন সুপারশপ ‘স্বপ্ন’। স্বপ্নের পণ্য বিক্রি অতীতের তুলনায় বেড়েছে। উচ্চপ্রযুক্তি ও ক্রেতা সন্তুষ্টি রক্ষা, সুনিয়ন্ত্রিত দূরদর্শী পরিকল্পনা ও উৎপাদিত পণ্যের উন্নত গুণগত মানের কারণে এসিআই’র অধিকাংশ পণ্য দেশের বাজারে জনপ্রিয়।
এসিআই এখন গোদরেজের সঙ্গে পোলট্রি, টেটলির সঙ্গে চা আর ডাবরের সঙ্গে প্রসাধন সামগ্রীর যৌথ ব্যবসা করছে। বাংলাদেশি কোম্পানি হিসেবে একমাত্র এসিআই-ই বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানির সঙ্গে সম-অংশীদারিত্বের সঙ্গে ব্যবসা করছে।
অর্জন-স্বীকৃতি
ব্যবসা-বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ২০১৮ সালে ১৭তম বাংলাদেশ বিজনেস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন এসিআই’র গ্রুপ চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলা। এসিআই বিভিন্ন সময়ে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি পেয়েছে। এসব অর্জন গ্রুপটির পণ্যের প্রতি আস্থা বাড়িয়েছে। এসিআই’র কয়েকটি স্বীকৃতি
২০১৯: চলতি মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ১১তম আর্ন্তজাতিক পোলট্রি শো ও সেমিনারে প্রথম পুরস্কার অর্জন করেছে এসিআই এনিমেল হেলথ
২০১৮: এসিআই অ্যাগ্রিবিজনেস ইন্টেলিজেন্ট ডিসিশন সাপোর্ট সিস্টেম প্রকল্পের কৃষিভিত্তিক সেলফোন অ্যাপ ‘ফসলী’ চ্যাম্পিয়ন হিসেবে বেসিস ন্যাশনাল আইসিটি অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে
২০১৭: আয়োডিনযুক্ত লবণ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সেরার সরকারি স্বীকৃতি পেয়েছে এসিআই সল্ট। একই বছর ‘এসিআই সল্ট’ ও ‘স্যাভলন’ অ্যান্টিসেপটিক বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরামের ‘বেস্ট ব্র্যান্ড অ্যাওয়ার্ড’ অর্জন করেছে। আর ‘অ্যাগ্রো অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছে এসিআই ক্রপ কেয়ার
২০১৬: সেরা আর্থিক প্রতিবেদনের জন্য দ্য ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশের (আইসিএবি) ‘বেস্ট প্রেজেন্ট অ্যানুয়াল রিপোর্ট অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছে এসিআই
২০০৮: ‘কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমস’ শীর্ষক আইএসও সনদ পায় এসিআই। এর আগে ২০০৪ সালে ‘এনভায়রনমেন্টাল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমস’ বিষয়ে একই সংস্থার স্বীকৃতি অর্জন করে
২০০৭: ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ‘ফাউন্ডিং মেম্বার অব দ্য গ্লোবাল কোম্পানিজ’ স্বীকৃতি পায় এসিআই।
সহযোগী প্রতিষ্ঠান ও পণ্য
এসিআই যেন আস্থার প্রতীক। বিশেষ করে দেশের তৃণমূল পর্যায়ের কৃষি ও কৃষকের কাছে। ফসলের বীজ, সার, কীট-বালাইনাশকসহ জীবন রক্ষাকারী পণ্য উৎপাদন-বিপণন করছে গ্রুপটি। একই সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রায় সব ক্ষেত্রে পদচারণা রয়েছে এ গ্রুপের। শুরুটা বন্ধুর হলেও সাফল্য ধরা দিয়েছে অল্প সময়ে। এসিআই’র সাফল্যের সারথি এক ডজনেরও বেশি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠান কৃষি খাতের উন্নয়নে ‘ফ্লোরা’, ‘সোনালিকা’, ‘ফসলী’, স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ‘স্যাভলন’, ভোগ্যপণ্যে ‘পিওর’ ও সুপারশপ ‘স্বপ্ন’কে মানুষের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে সুনামের সঙ্গে।
এসিআই ফর্মুলেশন: এসিআই’র প্রথম সহযোগী প্রতিষ্ঠান এসিআই ফর্মুলেশন। ১৯৯৫ সালে পথচলা শুরু। গণমানুষের স্বাস্থ্য ও কৃষকের শস্য সুরক্ষার দিকটি মাথায় রেখে রাসায়নিক সার, কীট-জীবাণু ও ছত্রাকনাশক পণ্য উৎপাদন করছে প্রতিষ্ঠানটি। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এ প্রতিষ্ঠানের জনবল প্রায় দুই হাজার। ফর্মুলেশনের উৎপাদিত পণ্য বেশ জনপ্রিয়। এ কারণে এসিআই ফর্মুলেশনের বেশ কয়েকটি ব্র্যান্ড কিনেছে কয়েকটি বিদেশি কোম্পানি।
এসিআই লজিস্টিকস: এসিআই’র আরেক সহযোগী প্রতিষ্ঠান এসিআই লজিস্টিকস। বাংলাদেশে সুপারশপ ব্যবসায় এক দশকের পথচলায় ব্র্যান্ড হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে ‘স্বপ্ন’। ২০০৮ সালে পথচলার শুরুর পর বর্তমানে ‘স্বপ্ন’র ৬০টি আউটলেট রয়েছে। ব্র্যান্ড ভ্যালুকে পুঁজি করেই আজকের এ অবস্থানে এসেছে প্রতিষ্ঠানটি। ক্রেতা ও টার্নওভারে দেশের সুপারশপগুলোর মধ্যে ‘স্বপ্ন’ শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। দৈনিক ৩৫ হাজারের বেশি গ্রাহককে সেবা দেওয়া প্রতিষ্ঠানটি তিন হাজারের বেশি কর্মীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এগিয়ে চলেছে।
এসিআই সল্ট: আয়োডিনযুক্ত লবণ উৎপাদনের জন্য ২০০৪ সালের জুনে নিবন্ধন নেয় এসিআই সল্ট। ‘পিওর’ ব্র্যান্ডের লবণ বাজারজাত করে স্বল্প সময়ে জনপ্রিয় হয়। এরই মধ্যে দেশসেরা আয়োডিনযুক্ত লবণ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতিও পেয়েছে। দেশের মানুষের আয়োডিনের চাহিদা পূরণের সঙ্গে সঙ্গে এসিআই গ্রুপের পথচলায়ও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে প্রতিষ্ঠানটি।
এসিআই ফর্মুলেশন, এসিআই লজিস্টিকস ও এসিআই সল্টসহ বর্তমানে প্রায় ১৪টি সহযোগী প্রতিষ্ঠান রয়েছে এসিআই গ্রুপের। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এসিআই পিওর ফ্লাওয়ার, এসিআই ফুডস, এসিআই মটরস্, ক্রিয়েটিভ কমিউনিকেশন্স, প্রিমিয়াফ্লেক্স প্লাস্টিকস, এসিআই অ্যাগ্রোলিংকস, এসিআই এডিবল অয়েলস, এসিআই হেলথকেয়ার, এসিআই কেমিক্যালস, এসিআই ইনফোলিটিয়েকস ও এসিআই বায়োটেকস উল্লেখযোগ্য। এসব প্রতিষ্ঠানের বদৌলতে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, প্রসাধন পণ্য, খাদ্য-ভোগ্যপণ্য উৎপাদন-বিপণন, কীট-বালাইনাশক পণ্য বিপণন, কৃষি যন্ত্রপাতি আমদানি-বিপণন ও কৃষিবিষয়ক সেবা প্রদানসহ বহুমুুখী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে এসিআই। সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রায় সব খাতে প্রবেশ করেছে এসিআই।
একইভাবে টেটলি (এসিআই), এসিআই গোদরেজ অ্যাগ্রোভেট ও এশিয়ান কনজুমার কেয়ার নামে তিনটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিদেশি কোম্পানির সঙ্গেও সমঅংশীদারিত্বের ভিত্তিতে যৌথভাবে ব্যবসা করছে এসিআই।