Print Date & Time : 16 June 2025 Monday 10:26 pm

এস আলমের দুই প্রতিষ্ঠানের বিআইএন লক, হিসাব জব্দ

রহমত রহমান: দেশের বিতর্কিত ব্যবসায়ী গ্রুপ এস আলম। এই গ্রুপের দুই প্রতিষ্ঠানের সুদসহ প্রায় ৭ হাজার ৭১ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি উদ্ঘাটিত হয়েছে। দুটি প্রতিষ্ঠান হলোÑ এস আলম ভেজিটেবল অয়েল লিমিটেড ও এস আলম সুপার এডিবল অয়েল লিমিটেড। ফাঁকি দেয়া রাজস্ব পরিশোধ না করায় দুটি প্রতিষ্ঠানের বিআইএন (বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার) লক (স্থগিত) করা হয়েছে। ফলে দুটি প্রতিষ্ঠানের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে। একইসঙ্গে রাজস্ব পরিশোধ না করায় দুটি প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ (অপ্রচলনযোগ্য) করা হয়েছে। চট্টগ্রাম ভ্যাট কমিশনারেটের আওতাধীন পটিয়া ভ্যাট বিভাগ থেকে দেশের ৫৭টি ব্যাংকে চিঠি দেয়া হয়েছে।

চট্টগ্রাম কমিশনারেটের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বকেয়া রাজস্ব পরিশোধ না করা হলে আইন অনুযায়ী গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠানের বিআইএন লক করার বিধান রয়েছে। ফলে এস আলম গ্রুপের এই দুটি প্রতিষ্ঠান ফাঁকি দেয়া রাজস্ব পরিশোধ না করা হলে সহযোগী ৯টি প্রতিষ্ঠানের বিআইএন লক করা হবে। এই ৯টি প্রতিষ্ঠানের ইতোমধ্যে ১৪১২ কোটি ৬৯ লাখ টাকা রাজস্ব ফাঁকি উদ্ঘাটন ও দাবিনামা জারি করা হয়েছে।
অপরদিকে দুটি প্রতিষ্ঠানের নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভ্যাট রিটার্নে কম ক্রয়-বিক্রয় দেখানোসহ বিভিন্ন উপায়ে ২০১৯ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে কোম্পানি দুটি ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে। এই সময়ের মধ্যে কোম্পানি দুটি তিন হাজার ৫৩৯ কোটি ৩১ লাখ টাকার ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে। যাতে জরিমানা করা হয়েছে তিন হাজার ৫৩১ কোটি ৮১ লাখ টাকা। জরিমানাসহ ফাঁকি দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৭১ কোটি ১২ লাখ টাকা। পটিয়া ভ্যাট বিভাগ এই নিরীক্ষা সম্পন্ন করে। পরে উদ্ঘাটিত রাজস্ব যাচাইয়ে চট্টগ্রাম ভ্যাট কমিশনারেটের অতিরিক্ত কমিশনারের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের পর্যালোচনা কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি যাচাই করে ফাঁকির সত্যতা পায়। ২০২৩ সালের অক্টোবরে জমা দেয়া নিরীক্ষা প্রতিবেদন এবং প্রতিবেদন তৈরির প্রায় আট মাস পর ২০২৪ সালের মে মাসে জমা দেয়া পর্যালোচনা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৯-২০ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরের মধ্যে তিন বছরে এস আলম ভেজিটেবল অয়েল লিমিটেডের বিরুদ্ধে এক হাজার ৯১৭ কোটি ৩৯ লাখ টাকা এবং এস আলম সুপার এডিবল অয়েল লিমিটেডের বিরুদ্ধে এক হাজার ৬২১ কোটি ১২ লাখ টাকা ফাঁকি দেয়া হয়েছে। কোম্পানি দুটির বিষয়ে ২০২৩ সালের ২ অক্টোবর প্রতিবেদন জমা দেয় নিরীক্ষা কমিটি। পরে নিরীক্ষা প্রতিবেদনটি পর্যালোচনার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। ২১ মে জমা দেয়া পর্যালোচনা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোম্পানি দুটির বিরুদ্ধে ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।

সূত্র আরও জানায়, ৯ জুন চট্টগ্রাম ভ্যাট কমিশনারেট ওই দুই প্রতিষ্ঠানকে পরবর্তী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে ফাঁকি দেয়া তিন হাজার ৫৩৯ কোটি ৩১ লাখ টাকা ভ্যাট, তিন হাজার ৫৩১ কোটি ৮১ লাখ টাকা জরিমানা এবং এর ওপর প্রযোজ্য সুদের টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে পরিশোধের নির্দেশ দেয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠান ভ্যাট পরিশোধ করেনি। তাগাদা দেয়া হলেও ভ্যাট পরিশোধ করেনি। যার ফলে বিআইএন লক ও ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে।

অপরদিকে গতকাল মঙ্গলবার চট্টগ্রাম ভ্যাট কমিশনারেটের আওতাধীন পটিয়া ভ্যাট বিভাগ থেকে দুটি প্রতিষ্ঠানের বিআইএন লক করা হয়েছে। একইসঙ্গে দুটি প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব জব্দ করতে দেশের ৫৭টি ব্যাংকে চিঠি দেয়া হয়েছে। পটিয়া ভ্যাট বিভাগের সহকারী কমিশনার ও বিভাগীয় কর্মকর্তা আসিফ আহমেদ অনিক বিষয়টি শেয়ার বিজকে নিশ্চিত করেছেন। বিআইএন লক করায় দুটি প্রতিষ্ঠানের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে।

তিনি বলেন, মূসক আইনের ধারা ৯৫ অনুযায়ী, কোনো প্রতিষ্ঠান বকেয়া রাজস্ব পরিশোধ না করলে সহযোগী প্রতিষ্ঠানের বিআইএন লক করা যায়। এস আলমের এই দুই প্রতিষ্ঠান বকেয়া পরিশোধ করেনি। ফলে আইন অনুযায়ী বকেয়া আদায়ে সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিআইএন লক করা হবে।
চট্টগ্রাম ভ্যাট কমিশনারেট সূত্রমতে, এস আলম গ্রুপের সহযোগী ১০ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠান (এস আলম স্টিল লিমিটেড, ইউনিট-২) বন্ধ রয়েছে। বাকি ৯টি প্রতিষ্ঠানের রাজস্ব ফাঁকি সুদসহ প্রায় এক হাজার ৪১২ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। ৯টি প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাট পরিশোধে পৃথক দাবিনামা সংবলিত কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করা হয়েছে। এর মধ্যে এস আলম স্টিলস লিমিটেড (ইউনিট-১ ও ৩) ৫৫ কোটি ৬৯ লাখ টাকা; চেমন ইস্পাত লিমিটেড ১৪৭ কোটি ৬৩ লাখ টাকা; এস আলম রিফাইন্ড সুগার ৭৫৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা; এস এস পাওয়ার লিমিটেড ২০০ কোটি ৮ লাখ টাকা; এস আলম পাওয়ার প্লান্ট লিমিটেড ২১ কোটি ৪৮ লাখ টাকা; এস আলম প্রোপারটিজ লিমিটেড ৫ কোটি ৭৬ লাখ টাকা; এস আলম কোল্ড রি-রোলিং মিলস লিমিটেড ২১৫ কোটি ৮১ লাখ টাকা; এস আলম ব্যাগ ম্যানুফ্যাকচারিং মিলস লিমিটেড ৩১ লাখ টাকা ও এস আলম সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ১০ কোটি ৫৩ লাখ টাকা।

অপরদিকে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর একে একে বেরিয়ে আসছে এই গ্রুপের বিভিন্ন অনিয়মের খরব। ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠানটির দখলে থাকা পাঁচটি ব্যাংকের বোর্ড পুনর্গঠন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যেগুলোয় বড় আকারের আর্থিক অনিয়ম সংঘটিত হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। এছাড়া ট্যাক্স অফিসও এস আলম গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির গত পাঁচ বছরে ২ লাখ কোটি টাকার বেশি লেনদেনের তথ্য উদ্ঘাটন করেছে।