এ মুহূর্তে জরুরি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় নজর দেয়া

নিজস্ব প্রতিবেদক: বর্তমান সংকটময় মুহূর্তে প্রবৃদ্ধি অর্জনের কথা চিন্তা করলে হবে না। আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিতের প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া জরুরি। প্রয়োজনে প্রবৃদ্ধি সেক্রিফাইস (উৎসর্গ) করে হলেও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য যা যা করা দরকার তাই করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে গিয়ে ৬ শতাংশ হলেও খারাপ কিছু হবে না। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) বার্ষিক গবেষণা সম্মেলনে গতকাল এমন তাগিদ দেন বক্তারা। রাজধানীর লেকশোর হোটেলে আয়োজিত তিন দিনব্যাপী সম্মেলনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘পোস্ট কভিড ইন এন ইউক্রেন অ্যান্ড ডিভিসিভ ওয়ার্ল্ড’। সম্মেলনের প্রথম দিন প্রায় ৯টি গবেষণাপত্র উপস্থাপন করা হয়।

উদ্বোধনী অধিবেশনে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। বিশেষ অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেনের সভাপতিত্বে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পিআরআই’র ভাইস চেয়ারম্যান সাদিক আহমেদ। দ্বিতীয় অধিবেশনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অর্থনীতিবিদ ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ। এ সময় সভাপতিত্ব করেন সিপিডির চেয়ারম্যান ড. রেহমান সোবহান।

মূল প্রবন্ধে সাদিক আহমেদ বলেন, করোনা-মহামারি পরবর্তী অবস্থায় বাংলাদেশ অর্থনীতি পুনরুদ্ধার হচ্ছে। কিন্তু বর্তমানে যেসব উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, সেগুলো অব্যাহত রাখা ঠিক হবে না। কেননা এখন প্রবৃদ্ধির দিকে নজর দেয়ার সময় নয়। এখন অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করতে হবে। এজন্য সুদের হারের ঊর্ধ্বসীমা তুলে দেয়া, মুদ্রা বিনিয়ম হার বাজারের হাতে ছেড়ে দেয়া, আমদানি নিয়ন্ত্রণ না করা এবং এলসি খোলা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। চাহিদার ওপর ছেড়ে দিতে হবে। এছাড়া রাজস্ব আদায় বাড়ানোসহ কাঠামোগত সংস্কার দরকার। বিশেষ করে একটি কর কমিশন গঠন করা যেতে যাতে। কেননা বাংলাদেশের কর আদায় হার বিশ্বের প্রায় সব দেশের চেয়ে কম। এসব উদ্যোগ নিলে চলতি অর্থবছর হয়তো প্রবৃদ্ধি কমে ৬ শতাংশ হতে পারে। কিন্তু সেটিও খারাপ হবে না।     

পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, অর্থনীতিতে ইতিবাচক মুভমেন্ট দেখা যাচ্ছে। জিডিপির তুলনায় কর আদায়কে মন্দ বলা হয়েছে। কিন্তু এত যদি ভয়ংকর অবস্থা হয় তাহলে ৫-৬-৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয় কীভাবে। নিশ্চয়ই রাজস্ব আদায়ের ঘাটতি কিছু একটা দিয়ে পুষিয়ে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে রাজস্ব খাতে বড় উল্লম্ফন আশা করা যায় না। যদিও আমাদের প্রচেষ্টা থাকবে কর আদায় বাড়ানো। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের ওপর ধরে রাখতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। মূল্যস্ফীতি সেপ্টেম্বর অক্টোবর মাসে কমে এসেছে। এটা বিবিএসের তথ্য। আমরা বিবিএস এবং বিআইডিএসের ওপরে আমাদের আস্থা রাখতে চাই।

পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেন, মূল প্রবন্ধে বলা হয়েছে চলতি অর্থবছর বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ হবে। কিন্তু এটা অতি সংরক্ষণশীল তথ্য। বুঝতে পারছি না আইএমএফের পূর্বাভাসকে কেন প্রবন্ধে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। গত অর্থবছরের চেয়ে চলতি অর্থবছরের চার মাসে অর্থনৈতিক সূচকগুলো ভালো অবস্থানে আছে। তাই এ বছর ৭ শতাংশের ওপর অবশ্যই জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে।

তিনি বলেন, ব্যাংক ঋণের সুদ হার ৯ ও ৬-এর পরিবর্তে ৯ এবং ১২ শতাংশ পর্যন্ত করা যেতে পারে। এটা ভেবে দেখতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক। এছাড়া কর কমিশন গঠন না করে রাজস্ব বোর্ডকে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ থেকে আলাদা করে স্বাধীন করা যায় কিনা সেটি ভাবতে হবে। নতুন প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন নেই। অর্থনৈতিক সূচকগুলোর অবস্থা তুলে ধরে তিনি বলেন, গত ৪ মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ৭ দশমিক ১৯৮ বিলিয়ন ডলার; যা গত অর্থবছর একই সময় ছিল ৭ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া রপ্তানি ১৬ বিলিয়ন ডলার হয়েছে, গত অর্থবছর ছিল ১৫ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার। আমদানি হয়েছে ২০ দশমিক  ৯০ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছর ৪ মাসে ছিল ১৮ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার। সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে ৪৫৭ মিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছর ছিল ৩৭৫ মিলিয়ন ডলার। দেখা যাচ্ছে প্রধান সূচকগুলোয় ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় আছে।

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, কিছু বড় বড় শিল্প গ্রুপের মুনাফা অর্জনকারী শিল্প প্রতিষ্ঠান থাকলেও তারা ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ না করে খেলাপি হয়ে যায়। এর একটা কারণ হলো, অবৈধভাবে বিদেশে মুনাফা পাচার। এক্ষেত্রে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে বাববার ঋণ পুনঃতফসিলীকরণ, সুদ মওকুফ ইত্যাদি সুবিধা দিতে হয়। কিন্তু এর পরিবর্তে সরকার আর্থিক সহায়তার অংশ হিসেবে মুনাফা অর্জনকারী কোম্পানিগুলোর কিছু শেয়ার সমমূল্যে অর্থাৎ শেয়ারপত্রে উল্লিখিত দামে কিনে নিতে পারে। এছাড়া ভালো কোম্পানি বাজারে শেয়ার ছাড়লেও সরকার আইন করে তার কিছু অংশও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে উল্লিখিত দামে কিনে নিতে পারে।

 তিনি বলেন, কর নীতির কিছু বড় পরিবর্তন ও বিবেচনা করা যায়। আমাদের দেশে সম্পত্তির উত্তরাধিকারে কর নেই, অথচ শিল্পোন্নত দেশগুলোয় উচ্চ হারে  এ ধরনের কর আরোপ করা হয়। অর্থনৈতিক সাম্যের প্রশ্নে আমাদের মতো অর্থনীতির একটি বড় চালিকাশক্তি। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের স্বার্থরক্ষার বিষয়টি উল্লেখ করা দরকার। বিনিয়োগের বাধা হিসেবে ব্যবসায় পরিবেশের নানা ত্রুটিবিচ্যুতি, বিশেষ করে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারাই তুলনামূলকভাবে এই বৈরী ব্যবসায় পরিবেশের বেশি ভুক্তভোগী।

বর্তমান বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক অসন্তোষ তৈরি হচ্ছে। আর্থিক খাতের অস্থিতিশীলতা, প্রাচুর্যের পাশাপাশি চরম বৈষম্য ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ক্রমবর্ধমান আধিপত্য এ ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। মুক্ত বাজার অর্থনীতি বর্তমান কালের একচ্ছত্র প্রভাবশালী অর্থনৈতিক দর্শন হিসেবে আবির্ভূত হলেও একে ক্ষোভ ও এক ধরনের অনিবার্যতার দৃষ্টি থেকে দেখা হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, গণতান্ত্রিক দেশের বাজার অর্থনীতিতে সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য অর্জনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান রাষ্ট্রের কর্তৃত্বে পর্যাপ্ত আয় ও সম্পদ। উন্নত গণতান্ত্রিক বিশ্বের দেশ কতখানি বামপন্থি নীতি অনুসরণ করতে পেরেছে তার প্রধান নির্দেশক হলো, জাতীয় আয় বা জিডিপির তুলনায় সরকারি রাজস্বের অনুপাত। যে নরওয়েকে সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের আদর্শ হিসেবে ধরা হয়, সেখানে রাজস্ব আয় জিডিপির অর্ধেকের বেশি। অন্যান্য স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশের রাজস্ব আয়ের অনুপাতও এর কাছাকাছি। এর মধ্যে পশ্চিম ইউরোপের জার্মানি ও ফ্রান্সকেও অন্তর্ভুক্ত করা যায়। শুধু যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের ব্যতিক্রম। যদিও বড় অঙ্কের ঘাটতি বাজেট দিয়েও তারা সরকারি ব্যয়কে জিডিপির ৪০ থেকে ৫০ শতাংশের কাছাকাছি নিয়ে যেতে পেরেছে। সে তুলনায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর ঘোষিত সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য অর্জনের সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা সরকারের রাজস্ব আয়ের স্বল্পতা। দক্ষিণ এশিয়ায় জিডিপির অনুপাতে রাজস্ব আয় শুধু ভারত আর নেপালে ২০ শতাংশের কাছাকাছি। অন্যদিকে শ্রীলংকা ও বাংলাদেশে এই অনুপাতে মাত্র ১০ শতাংশ বা তার কম। এর মধ্যে শ্রীলঙ্কা জনতুষ্টিমূলক নীতি হিসেবে কর রেয়াত ও সামাজিক সুরক্ষা ব্যয় বাড়িয়ে প্রমাণ করেছে যে বিদেশ থেকে ধার করা অর্থে সমাজতান্ত্রিক উন্নয়নের লক্ষ্য পূরণ করতে গেলে দেউলিয়া হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, আমাদের দেশে চরম বৈষম্য বিরাজ করছে। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে সবকিছুই বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। বাজার ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে। এছাড়া ব্যবসার পরিবেশ উন্নত করা জরুরি। স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে হবে। বর্তমান সিস্টেমের কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে হবে। তাহলেই বৈষম্য কমবে। দারিদ্র্য নিরসন এবং করকাঠামো সংস্কার দরকার। কল্যাণমূলক সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। রাজনৈতিক ক্ষমতাকে গ্রাস করছে অর্থনৈতিক ক্ষমতা। ফলে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে শুরু করে সব জায়গায় ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা জনপ্রতিনিধিতে পরিণত হচ্ছেন।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০