আরিফ হোসেন, বরিশাল:‘তুমি বেশ বদলে গেছো, পুরোনো সৈকতে আর পানসি ভেড়াও না’ কিংবা ‘মন মাঝি তোর বৈঠা নেরে আমি আর বাইতে পারলাম না’ একসময় নৌকায় চড়ে দূরে কোথাও যাতায়াত কিংবা নতুন বউকে নৌকায় চড়িয়ে বাবার বাড়ি থেকে স্বামীর বাড়িতে আনার সময় মাঝি-মাল্লার এসব গান মন কাড়ত। নৌকায় ভাটিয়ালি, মুর্শিদি ও মারিফতি গানে মন কেড়ে নিত। সে সময় বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলবাসীর চলাচলের একমাত্র ও অন্যতম মাধ্যম ছিল পালতোলা পানসি, গয়না, ছইওয়ালা (একমালাই) ও রাজাপুরী নৌকা। এছাড়া জমিদারদের চলাচলের জন্য ময়ূরপঙ্খী, ধনাঢ্য ব্যক্তিদের জন্য বজরা ও পণ্য পরিবহনের জন্য সাম্পান, বালার ও বাতনাই নৌকার প্রচলন ছিল।
কালের বিবর্তনে অনেক নদী-খাল দখল ও ভরাট হয়ে যাওয়ায় হারিয়ে গেছে ঐতিহ্যবাহী এসব নৌকা। এখন কালেভদ্রে কোথাও এসব নৌকার দেখা মেলে না। তবে এখনও বর্ষা মৌসুমে দক্ষিণাঞ্চলের বিলাঞ্চলবাসীর যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনের একমাত্র বাহন নৌকা। এ অঞ্চলের লাখ মানুষের মৎস্য শিকারের কাজেও অন্যতম ভূমিকা রাখে নৌকা। নৌকায় জাল, চাঁই (মাছ ধরার ফাঁদ) অথবা বড়শি নিয়ে মৎস্য শিকারে ছুটে চলেন জেলেরা। তবে এসব নৌকাকে অঞ্চলভেদে পেনিস, ডিঙ্গি, কোসা ও মাছ ধরার নৌকা বলা হয়। এছাড়া পণ্য পরিবহন ও জেলেদের মাছ ধরার কাজে নৌকার ব্যবহার চোখে পড়ে।
গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশক থেকে বাংলাদেশে নৌকায় ইঞ্জিন লাগানো শুরু হয়। তখন নৌকা যান্ত্রিক নৌযানে পরিণত হয়। এ যান্ত্রিক নৌকাগুলো শ্যালো নৌকা নামে পরিচিত। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ে ভেসে বেড়ায় সাম্পান নৌকা। বর্তমানে চট্টগ্রাম ও কুতুবদিয়া এলাকায় সাম্পান নৌকা বেশি দেখা যায়। যাত্রী পারাপারে গয়না নৌকা ব্যবহƒত হতো। একসঙ্গে প্রায় ৩০ জন পর্যন্ত যাত্রী বহন করার ক্ষমতা ছিল এ নৌকার। বর্তমানে গয়না নৌকা বিলুপ্তি হয়ে গেছে। অতীতে ধনবানরা শখ করে নৌকা ভ্রমণে যেতেন। তাদের কাছে বেশ জনপ্রিয় ছিল বজরা নৌকা।
নৌকা বাংলাদেশে এতটাই জীবনঘনিষ্ঠ ছিল যে, একে ঘিরে হতো অনেক মজার খেলা। তার মধ্যে নৌকাবাইচ এখনও একটি জনপ্রিয় খেলা। অতীতে রাজা বাদশাহদের সৌখিন নৌকা ছিল ময়ূরপঙ্খী। সবচেয়ে পরিচিত নৌকা ডিঙি। নদীর তীরে যারা বাস করেন তারা সবাই এ নৌকাটি ব্যবহার করেন নদী পারাপার বা অন্যান্য কাজে। আকারে ছোট বলে এই নৌকাটি চালাতে একজন মাঝিই যথেষ্ট। প্রাচীনকালে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য ব্যবহƒত বিখ্যাত নৌকা ছিল বালার ও বাতনাই। এই নৌকাগুলো আকারে অনেক বড় এবং প্রায় ৫০ থেকে ৫৫ টন পর্যন্ত পণ্য বহন করতে পারত। দেশের প্রায় সব জায়গায় কমবেশি মাছ ধরা নৌকা দেখা যায়। তবে সমুদ্র উপকূল দক্ষিণাঞ্চলের পটুয়াখালী, বরগুনা, মনপুরা এলাকায় এ নৌকা বেশি দেখা যায়। ঐতিহ্যবাহী এ নৌকায় এখন ইঞ্জিন যুক্ত হয়েছে। নামও বদলে গেছে। এখন এসব নৌকা ফিশিং ট্রলার বা মাছধরা ট্রলার নামে বেশি পরিচিত। বরিশাল, পিরোজপুর ও ঝালকাঠীর বিভিন্ন উপজেলায় পেনিস নৌকা তৈরি করা হয়। জ্যৈষ্ঠ থেকে আশ্বিন পর্যন্ত স্বরূপকাঠীর আটঘর, কুড়িয়ানা, ইন্দেরহাট, আগৈলঝাড়ার সাহেবেরহাট ও গৌরনদী মাহিলাড়ায় বসে নৌকার হাট। এসব উপজেলায় শাকসবজি ও তরকারিসহ পেয়ারা এবং লেবুর ব্যাপক ফলন হয়। এসব কৃষিপণ্য হাটবাজারে পরিবহনের জন্য খাল-বিল পার থেকে ছোট নৌকার বিকল্প নেই। কুরিয়ানা বাজারে প্রতিদিন গড়ে পাঁচ শতাধিক নৌকা বিক্রি হয়ে থাকে। বর্ষা মৌসুমের শুরু থেকেই বিভিন্ন স্থানে চলে নৌকা বানানোর ধুম। আগৈলঝাড়ার বারপাইকা, দুশুমি, রামানন্দেরআঁক, স্বরূপকাঠী, বানারীপাড়া উপজেলার ইন্দেরহাট, ইলুহার, আতাকোঠালী ও বৈঠাকাটা গ্রামের অসংখ্য পরিবার নৌকা তৈরির পেশায় নিয়োজিত। তারা স্বরূপকাঠী থেকে কাঠ কিনে নৌকা তৈরি করে থাকেন। একসময় নৌকায় চড়ে দূরে কোথাও যাতায়াতের একমাত্র ও অন্যতম মাধ্যম ছিল পালতোলা পানসি ও ছইওয়ালা (একমালাই) নৌকা। পানসি নৌকা হারিয়ে গেলেও আজো দেখা মেলে ছইওয়ালা নৌকার।
কয়েক বছর আগেও বরিশালের বিলাঞ্চলখ্যাত আগৈলঝাড়া উপজেলার সবখানে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল নৌকা। এখন বদলে গেছে বিলাঞ্চলের জীবনমানের চিত্র। বেশিরভাগ এলাকায় এখন সড়ক পথে যোগাযোগের জন্য উন্নত মানের রাস্তাঘাট নির্মাণ হয়েছে। এ কারণে ক্রমেই ওইসব এলাকা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে চিরচেনা নৌকা।