ওমিক্রন নিয়ে প্রস্তুতি নেই বাংলাদেশের!

নজরুল ইসলাম: দেশে কভিড-১৯ ভাইরাস নেই এমন মন-মানসিকতাই বিরাজ করছে মানুষের মাঝে। আর কভিড ভাইরাসের নতুন ধরন ‘ওমিক্রন’কে তো পাত্তাই দিচ্ছেন না তারা। মানুষের মাঝে কোনো সচেতনতাই দেখা যাচ্ছে না। স্বাস্থ্যবিধিও মানা হচ্ছে না সব ক্ষেত্রে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ১৫টি নির্দেশনা দিলেও কোনো বাস্তবায়ন নেই।

যদিও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, দরজায় কড়া নাড়ছে ওমিক্রন। অথচ স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলছেন, দেশে লকডাউন ও সীমান্ত বন্ধ করার মতো পরিস্থিতি এখনও হয়নি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে এখন কভিড সংক্রমণের হার দুই শতাংশের নিচে। এর পরও আত্মতুষ্টিতে ভোগার কোনো কারণ নেই। রক্ষা পেতে স্বাস্থ্যবিধি অবশ্যই মানতে হবে।

সম্প্রতি দক্ষিণ আফ্রিকাফেরত ২৪০ জনের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। তাদের মোবাইল ফোনও বন্ধ। এ অবস্থায় তাদের মাধ্যমে কভিডের নতুন ধরন ওমিক্রন ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও বাড়ছে।

সংক্রামক রোগের গাণিতিক মডেলিংয়ে বিশেষজ্ঞ কিয়োটো ইউনিভার্সিটির স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত বিজ্ঞানের অধ্যাপক হিরোশি নিশিউরার গবেষণায় উঠে এসেছে, ওমিক্রন ডেল্টার চেয়ে চার দশমিক দুইগুণ বেশি সংক্রামক। দক্ষিণ আফ্রিকার গাউটেং প্রদেশ থেকে ২৬ নভেম্বর পর্যন্ত পাওয়া জিনগত তথ্য পর্যালোচনা করেছেন তিনি। বুধবার জাপানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা প্যানেলের এক বৈঠকে হিরোশি নিজের অনুসন্ধানের তথ্য তুলে ধরেন। এতে তিনি বলেন, ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট বেশি সংক্রামক। আক্রান্ত হওয়ার কারণে ও টিকা নেয়ার ফলে সৃষ্ট ইমিউনিটিকে এটি ভেদ করতে পারে। বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম ব্ল–মবার্গ এ খবর জানিয়েছে। এদিকে এনডিটিভি জানিয়েছে, প্রথম শনাক্ত হওয়া দেশ দক্ষিণ আফ্রিকায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। এখন দেশটিতে দৈনিক আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার।

৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিবেশী দেশ ভারতে মোট ২১ জনের ওমিক্রন শনাক্ত হয়েছে। আর এখন পর্যন্ত বিশ্বের ৫৭টি দেশে ওমিক্রন শনাক্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন ছড়িয়ে পড়ায় আক্রান্ত দেশগুলো থেকে বাংলাদেশে যাত্রী আসা বন্ধ করার সুপারিশ করেছে কভিড-১৯-বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি। তবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী শুধু সাতটি দেশ থেকে আগত মানুষের ক্ষেত্রে কোয়ারেন্টাইনের কথা জানিয়েছেন। সেগুলো হলো বতসোয়ানা, ইসোয়াতিনি, ঘানা, নামিবিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, জিম্বাবুয়ে ও লেসোথো।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও পরিচালক (রোগ-নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘দরজায় কড়া নাড়ছে করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন। দেশে এখন কভিড সংক্রমণের হার দুই শতাংশের নিচে। এর পরও আত্মতুষ্টিতে ভোগার কোনো কারণ নেই, কারণ ঘরের দরজায় বিপজ্জনক ধরন ওমিক্রন কড়া নাড়ছে। এই মুহূর্তে সবাইকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে। সবাইকে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে, মাস্ক পরতে হবে। এগুলো নিশ্চিত করতে পারলে ওমিক্রন হোক বা অন্য কোনো ধরন হোক, তা আমরা মোকাবিলা করতে সক্ষম হব।’

তিনি বলেন, ‘ওমিক্রন মোকাবিলায় আমরা প্রস্তুত আছি। এক্ষেত্রে কমিউনিটিতে আমাদের সবার প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করা জরুরি। একইসঙ্গে অন্যকে অনুপ্রাণিত ও উদ্বুদ্ধ করা এবং সহায়তার মধ্য দিয়েই আমরা এ ভাইরাসটিকে শতভাগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারব বলে মনে করি।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ১৫ নির্দেশনার মধ্যে অন্যতম হলোÑসব ধরনের সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও অন্যান্য জনসমাগম নিরুৎসাহিত করা, প্রয়োজনে ঘরের বাইরে যাওয়া প্রত্যেক ব্যক্তির সর্বদা সঠিকভাবে নাক-মুখ ঢেকে মাস্ক পরাসহ সব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করা, রেস্তোরাঁয় বসে খাওয়ার ব্যবস্থা ধারণক্ষমতার অর্ধেক বা তার কম রাখা, সব ধরনের জনসমাবেশ, পর্যটনস্থান, বিনোদন কেন্দ , রিসোর্ট, কমিউনিটি সেন্টার, সিনেমা হল বা থিয়েটার হল ও সামাজিক অনুষ্ঠানে (বিয়ে, বৌভাত, জন্ম  দিন, পিকনিক পার্টি প্রভৃতি) ধারণক্ষমতার অর্ধেক বা তার কমসংখ্যক লোকের অংশগ্রহণ, মসজিদসহ সব উপাসনালয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করা এবং গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এসব নির্দেশনা বাস্তবায়িত হচ্ছে না।

গত ৭ ডিসেম্বর এক সেমিনারে গণবিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও বিশিষ্ট সংক্রমণ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. বিজন কুমার শীল বলেন, ‘ওমিক্রনে মিউটেশন অনেক বেশি। ফলে এর পরিবর্তনও ব্যাপক। এতে নতুন ধরনটি শক্তিশালী হওয়ার পাশাপাশি ভ্যাকসিনের কার্যকারিতাও কমতে পারে। এজন্যই মনে করা হচ্ছে, ওমিক্রন হয়তো ডেল্টার চেয়েও ভয়ানক হবে। তবে ওমিক্রন এরই মধ্যে বিশ্বের ৪৫টি দেশে শনাক্ত হলেও এ নিয়ে ভয়ের কিছু নেই। সংক্রমণ প্রতিরোধে সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মানার ওপর জোর দিতে হবে।’

বিজন কুমার বলেন, ‘ওমিক্রনকে ভয়ংকর ভাবার কারণ এর মিউটেশন। এখন পর্যন্ত ডেল্টার সর্বোচ্চ ১৫টি মিউটেশন হয়েছে। ওমিক্রনের হয়েছে প্রায় ৫০টি, যার মধ্যে ৩২টি মিউটেশন হয়েছে স্পাইক প্রোটিনে, যা দিয়ে সে মানুষকে খুব অল্প সময়ে সংক্রমিত করে। এছাড়া ১০টি মিউটেশন হয়েছে রিসেপ্টার ডোমেইন সাইডে। ভাইরাসের যে অংশটি প্রথম মানুষের দেহকোষের সঙ্গে সংযোগ ঘটায় তার নাম রিসেপ্টার বাইন্ডিং ডোমেইন।’

এই সংক্রমণ বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, ‘ফিউরিন নামক একটি প্রোটিন পুরো ভাইরাসের বৈশিষ্ট্যকে পরিবর্তন করে দিতে পারে। এটি সার্সকভ-১-এ ছিল না, তবে সার্সকভ-২-তে আছে। এখন এটি যদি আরও বিস্তার লাভ করে, তাহলে ডেল্টার চেয়েও মারাত্মক হতে পারে। তবে এ মুহূর্তে ডেল্টার মতো আতঙ্কিত করার অবস্থায় যায়নি ওমিক্রন। যদিও এটাই শেষ নয়, অবস্থা খারাপ হতে পারে। আফ্রিকা থেকে অন্যান্য দেশে শনাক্ত হওয়ার পর এটি আরও শক্তিশালী হয়েছে। সংক্রমণ যত বাড়বে ততই এটি মারাত্মক হতে থাকবে।’

ড. বিজন বলেন, ‘এরই মধ্যে যারা ভ্যাকসিন নিয়েছেন, তারা অনেকটা সুরক্ষিত। তবে এর বিপরীতে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা কতটুকু, সেটি সম্পর্কে এখনও পর্যালোচনা চলছে।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান খসরু বলেন, ‘দেশের ১৫ কোটি মানুষকে ৩০ কোটি মাস্ক বিনা মূল্যে দিতে কী সমস্যা? সাদা-লাল রঙের দুই ধরনের মাস্ক দিয়ে বিশেষ ব্যবস্থায় প্রতিটি শহরে সাত দিনের মধ্যে মানুষকে সচেতন করা যায়। ১৬ ডিসেম্বর থেকে শুরু করেন, এতে সরকারের পদক্ষেপ সম্পর্কে মানুষ জানতে পারবে, গুরুত্ব দেবে। একইসঙ্গে প্রচুর বিশ্ববিদ্যালয়ে সিকুয়েন্স করার সক্ষমতা আছে, পিসিআর পরীক্ষা একেবারেই সহজ অবস্থায়। তাহলে এমন একটা সিদ্ধান্ত নিতে কি এত সময় লাগে?’

ডা. সায়েদুর আরও বলেন, ‘এখন রেস্টুরেন্টে গেলে ভ্যাকসিন সনদ চায়। আমরা জানি, নিবন্ধিত ৮০-৯০ লাখ এবং নিবন্ধন ছাড়া প্রায় কোটির মতো বয়স্ক মানুষ এখনও টিকার বাইরে। আমাদের বুঝতে হবে ঝুঁকি কার বেশি। ঝুঁকিতে থাকা মানুষের টিকা নিশ্চিত না করে নিচে নেমে আসা, বুস্টার ডোজ দেয়া অনৈতিক, এটা বিজ্ঞানসম্মত নয়। যেখানে মৃতদের বেশিরভাগই বয়স্ক, সেখানে তারা টিকার বাইরে থাকার তো কোনো কারণ নেই।’

এদিকে সাভারে এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক দাবি করেছেন, ওমিক্রনের বিস্তার ঠেকাতে সব ধরনের প্রস্তুতি আছে। তিনি বলেন, ‘সীমান্ত বন্ধ করার মতো পরিস্থিতি এখনও হয়নি। ওমিক্রন মোকাবিলায় একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় এরই মধ্যে অনেকগুলো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী বেশকিছু কার্যক্রমও শুরু হয়েছে। এই মুহূর্তে বর্ডার বন্ধ করার কোনো পরিকল্পনা নেই। দেশ ভালো আছে, নিরাপদে আছে। এখনও এমন পরিস্থিতি হয়নি যে বর্ডার বন্ধ করতে হবে বা লকডাউন দিতে হবে। সীমান্ত এলাকার প্রতিটি বর্ডারে স্ক্রিনিং ও পরীক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।’

মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা আমাদের হাসপাতালগুলোকে প্রস্তুত রেখেছি। এরই মধ্যে জেলায় জেলায় চিঠি দিয়েছি, তারা যেন ওমিক্রন মোকাবিলায় প্রস্তুতি নেন। আফ্রিকার সাত দেশ থেকে আসার ৪৮ ঘণ্টা আগে কভিড পরীক্ষা করা এবং দেশে আসার পর ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে থাকার বাধ্যবাধকতা দেয়া হয়েছে। সীমান্তেও পরীক্ষা কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। ঢাকায় যেসব হাসপাতালে কভিড চিকিৎসা হয়, সেগুলো প্রস্তুত করা হয়েছে।’

স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘যারা দেশের বাইরে আছেন, তাদের এই মুহূর্তে দেশে না আসাই ভালো। পরিবার ও দেশকে নিরাপদে রাখার জন্য এই মুহূর্তে আপনারা যেখানে আছেন সেখানেই থাকুন। দেশকে নিরাপদে রাখুন এবং আপনারাও নিরাপদে থাকুন।’

৪ ডিসেম্বর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর স্বাক্ষরিত কভিড-১৯ পরিস্থিতির বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তিন হাজার ৩৫ জনের আরটি পিসিআর পরীক্ষা করা হয়। এতে একজনের কভিড শনাক্ত হয়েছে। তবে সেটি কভিডের নতুন ধরন ‘ওমিক্রন’ কি না, সে তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। বিদেশ থেকে আগত যাত্রীদের মধ্যে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলোয় আট হাজার ৫০৬ জন, স্থলবন্দরগুলোয় ৯৩৮ জন ও সমুদ্রবন্দরগুলোয় ১৪০ জনের স্ক্রিনিং করা হয়। ওই দিন মোট ৯ হাজার ৫৮৪ জনের স্ক্রিনিং করা হয়। তবে রেলওয়ে স্টেশনে কোনো যাত্রীর স্ক্রিনিং করা হয়নি। বর্তমানে রেলওয়ে স্টেশনে যাত্রীর স্ক্রিনিং করা বন্ধ রয়েছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০