মেজবাহ হোসেন: ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স বা পদমর্যাদা ক্রম হলো মূলত রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও কর্মকর্তাদের পদের ক্রম বিন্যাস; যার মাধ্যমে তাদের প্রটোকল বা সুপিরিওরিটি নির্ধারিত হয়ে থাকে। ১৯৭৪ সালের ১১ জানুয়ারি প্রথম ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স জারি হওয়ার পর বেশ কয়েকবার এর পরিবর্তন ও পরিমার্জন করা হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে পাঁচ বিচারকের বেঞ্চ ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স সংশোধন করে রায় প্রদান করেন; যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হলো প্রধান বিচারপতি ৪নং ক্রম থেকে এক ধাপ ওপরে উঠে স্পিকারের সঙ্গে ৩নং ক্রমে অবস্থান করবেন আর জেলা জজগণ ২৪নং থেকে ওপরে ওঠে ১৬নং ক্রমে সচিবদের সঙ্গে অবস্থান করবেন। এই রায়ের ফলে প্রধানমন্ত্রী সংসদে বলেন, এভাবে নিজেরাই নিজেদের প্রমোশন দেয়া আনইথিকেল। সে ক্ষেত্রে জনগণের মনে খুব স্বাভাবিক একটি প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, তাহলে নির্বাহী বিভাগ কার কাছ থেকে প্রমোশন নিয়ে সবার ওপরে অবস্থান করছে? তারাও তো নিজেরাই নিজেদের অবস্থান নির্ধারণ করে নিয়েছে। আর সরকার যদি অন্যদের ওপরে ইনসাফ না করে বা অন্যদের যৌক্তিক দাবি আমলে না নেয় সে ক্ষেত্রে বিচার বিভাগ নিজেরা নিজেদের বিচার করলে খুব কি দূষণীয় বা আনইথিকেল হয়ে যায়? যাইহোক, আমি এই বিষয়ের পণ্ডিত মানুষ নই আর আজকের লেখার বিষয়বস্তুও এটি নয়।
মূল আলোচনা হলো এই পদমর্যাদা ক্রম কেন শুধু ক্ষমতার মানদণ্ডকে প্রাধান্য দিয়ে করা হয়েছে। আমাদের পদমর্যাদা ক্রম লক্ষ করলে দেখা যাবে সাংবিধানিক পদসমূহ, বিচার বিভাগ, বিভিন্ন সংস্থা, কমিশন, ব্যুরোপ্রধান, প্রশাসন, পুলিশ, তিন বাহিনীর সদস্য (৫ম গ্রেড পর্যন্ত) এবং নির্বাচিত প্রতিনিধি যেমন মেয়র, জেলা ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। বিশিষ্ট ব্যক্তি হিসেবে জাতীয় অধ্যাপক আর বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাহী প্রধান হিসেবে উপাচার্যের বাইরে টেকনিক্যাল ক্যাটেগরিতে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেকশন গ্রেডের অধ্যাপকরা (গ্রেড-১) এতে স্থান পেয়েছে।
একটি রাষ্ট্রে কি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি শুধু এই ক’জন; সমাজ গঠনে বা বিকাশে অন্য কারও বিশেষ অবদান নেই? অবশ্যই আছে এবং এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির তালিকা নিদেনপক্ষে হলেও আরও কিছুটা বিস্তৃত। রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদা ক্রম নির্ধারণ নিয়ে যখন নির্বাহী প্রধান ও বিচার প্রধান মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়ায় তখন এই তালিকায় স্থান পাওয়া বা না পাওয়ার তাৎপর্য কতখানি সেটি বুঝতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। আর হয়তো সেই কারণেই পদমর্যাদা ক্রমে ২৪নং ধাপে অবস্থান করা একজন জেলা প্রসাসক (৫ম গ্রেড) তার অফিসে উপবিষ্ট একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের (সহযোগী অধ্যাপক, গ্রেড-৪) পরিচয় জানার প্রচেষ্টা ব্যতিরেকেই তার কাছে স্যার সম্বোধন প্রত্যাশা করে বা করোনাকালে কর্তব্যরত একজন ম্যাজিস্ট্রেট চিন্তায় করতে পারে না যে তার থেকেও উচ্চপদস্থ অন্য কোনো ডিসিপ্লিনের সরকারী কর্মকর্তা সরকারি দায়িত্ব পালনেই রাস্তায় বের হতে পারে; ফলে তার আচরণ, প্রটোকল বা ক্ষমতা প্রদর্শনের লাগাম টানার কোনো তাগাদাই অনুভব করে না।
সরকারের একজন উপসচিব, একজন মেজর বা একজন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ঠিক কতটুকু ভূমিকা রাখে যে তারা পদমর্যাদা ক্রমে স্থান পেলেও একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের চিফ সায়েন্টিফিক অফিসার, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, প্রকৌশলী বা কৃষিবিদকে আমাদের রাষ্ট্রে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে গণ্য করা হয় না! কাউকে পদমর্যাদা ক্রমে স্থান দেয়া মানে এই নয় যে তাকে সবসময় চেয়ার পেতে বসতে দিতে হবে, বরং এর ফলে তাদের কাজের, মেধার, অবদানের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়া হয় এবং অপরাপর পেশাজীবীদের সঙ্গে ওয়ার্কিং রিলেশন ও প্রোটকলের ভারসাম্য রক্ষা করা যায়।
আমাদের দেশে বর্তমানে কৃষি উৎপাদন ও পশু পালনে যে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জিত হয়েছে তার পুরো কৃতিত্ব বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বিএলআরআই, বারি’র মতো প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপক ও গবেষকদের। আবিষ্কার বা উদ্ভাবনে হয়তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল কোনো সফলতা নেয় কিন্তু দেশে যে আজ দেড়শটিরও বেশি বিশ্ববিদ্যালয়, সেগুলোর জন্য শিক্ষিত জনবল সরবরাহ, শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টি ও জ্ঞান বিতরণে বিশ্ববিদ্যালয়টির ভূমিকা অনস্বীকার্য।
কিছুদিন আগে সিলেটের জাফলংয়ে স্টোন ক্রাসারে এক নারী শ্রমিকের হাত সম্পূর্ণ কাটা পড়ার ১০ ঘণ্টা পর সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজে গেলে যে চিকিৎসক ও তার টিম মিলে সৃষ্টিকর্তার অপার মহিমায় কাটা হাতটি আবার জোড়া লাগাতে সক্ষম হলেন, ওই শ্রমিকের জীবনে তার অবদানের সঙ্গে আর কার তুলনা করা যেতে পারে? এমন অসম্ভব পারঙ্গম সেবা প্রদানকারীদের মেধার স্বীকৃতি না দেয়াটা অন্যায়, অন্যায্য।
রাজনৈতিক ব্যক্তিরা ক্ষমতায় গিয়ে নিজেদের চাওয়া-পাওয়া নিজেরা আদায় করে নেয়, বিচার বিভাগের রায় লেখার ক্ষমতা আছে। তাই তারাও বাদ যায় না; প্রশাসন, পুলিশ আর সেনাবাহিনী ক্ষমতার সমীকরণে গুরুত্বপূর্ণ চলক তাই তাদের অখুশি রাখার সাহস কেউ দেখায় না। কিন্তু যেসব টেকনিক্যাল বিশেষজ্ঞ পেশাজীবীরা নীরবভাবে রাষ্ট্রের সেবায় নিরলসভাবে শ্রম দিয়ে যাচ্ছে তারা নিজেদের দাবি ঠিক কার কাছে জানাতে পারে, সরকার নাকি বিচারালয়ের কাছে? সর্বশেষ পদমর্যাদা ক্রম সংশোধনের সময় বিচারকগণ যদি শুধু নিজেদের কথা না ভেবে সকল পেশাজীবীদের বিষয়ে যুক্তিযুক্ত পর্যালোচনা করে ইনক্লুসিভ রায় দিত তাহলে সেটি অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য ও সমাদৃত হতো।
যেহেতু উপসচিব ও মেজরের মতো ৫ম গ্রেডের মিড অ্যাভারেজ কর্মকর্তাদের পদমর্যাদা ক্রমের সর্বশেষ তথা ২৫নং ধাপে স্থান দেয়া হয়েছে তাই উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণ অধ্যাপক, সরকারি মেডিকেল কলেজ ও মাস্টার্স কলেজের অধ্যক্ষ, বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের চিফ সায়েন্টিফিক অফিসার ও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা পেশাজীবীদের পদমর্যাদা ক্রমের ২৩ বা ২৪নং ধাপে স্থান দেয়াটা আবশ্যিক বলে মনে হয়। বিশেষ অবদান রাখা পেশাজীবীদের সংজ্ঞায়িত করার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী বা আলোড়ন সৃষ্টিকারী আবিষ্কার বা সেবা প্রদানের ভিত্তিতে ‘সিভিল সার্ভিস আউটস্ট্যান্ডিং অ্যাওয়ার্ড’ বা অনুরূপ পদকে প্রতি বছর ৩ থেকে অনধিক ৫ জনকে ভূষিত করা যেতে পারে। এ ছাড়াও খেতাবপ্রাপ্ত জীবিত মুক্তিযোদ্ধা; কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী, অভিনয়শিল্পী এবং ক্রীড়া তারকা যারা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশ ও বাংলাভাষাকে প্রতিনিধিত্ব করে তাদের স্বাধীনতা বা একুশে পদকে ভূষিত করে (এটা করা হয়) ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে স্থান দেয়া রাষ্ট্রের কর্তব্য।
শিক্ষক
রসায়ন বিভাগ
হাবিপ্রবি (বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যয়নরত)
mezbahhossain15@gmail.com